তিন
দুমাইল দুরের নতুন বড় গোরস্থানে প্রিয় পুত্রকে সমাহিত করে হোয়াইট দম্পতি বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়িটি এখন শোকের ছায়া আর নির্জনতায় ভরা। ঘটনাগুলো এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে তাঁরা যেন কিছুই বুঝতে উঠতে পারছিলেন না। তাঁদের মনে হচ্ছিল, হয়তো আরও কিছু ঘটবে। তাঁদের এই পাষাণভার হালকা হয়ে যাবে। এই বয়সে ওই ভার আর তারা বইতে পারছিলেন না। তাঁদের মনে হচ্ছিল হয়তো আরও কিছু ঘটবে। তাঁদের এই পাষাণভার হালকা হয়ে যাবে। এই বয়সে ওই ভার আর তাঁরা। বইতে পারছিলেন না।
কিন্তু দিন গেল । আশা করতে করতে এক সময় তাঁরা যেন সব কিছু ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দিলেন। তাঁদের এই আশাহীন আত্মসমর্পণ অনেকে উদাসীনতা মনে করল । অনেক সময় তারা নিজেদের মধ্যেও কথা বলতেন না। কারণ তাঁদের কথা বলার আর কিছু ছিল না। তাঁদের দিনগুলো ছিল দীর্ঘ ক্লান্তিতে ভরা।
প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল। একদিন রাত্রে হঠাৎ মি. হোয়াইটের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়িয়ে বুঝতে পারলেন বিছানায় তিনি একা। ঘরে আলো জ্বলছে না। জানালার ধার থেকে একটা চাপা কান্নার শব্দ আসছিল। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, বিছানায় এসো। তোমার ঠান্ডা লাগবে।
কত আর ঠান্ডা লাগবে, মিসেস হোয়াইট বললেন, ফের ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি।
কান্নার শব্দ আর মি. হোয়াইটের কানে গেল না। গরম বিছানায় তাঁর চোখ জোড়া যেন জড়িয়ে আসছিল। তার তন্দ্রা এসে গেল। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেল। মিসেস
হোয়াইট পাগলের মতো চিৎকার করে বলছেন, বানরের থাবা! বানরের থাবা!
মি. হোয়াইট চমকে উঠলেন। তাঁর চোখে মুখে ভয়। বললেন, কোথায় বানরের থাবা? কী হলো?
মিসেস হোয়াইট টলমল পায়ে তাঁর দিকে ছুটে এলেন। শান্ত গলায় বললেন, আমি সেটা চাই। তুমি নষ্ট করে ফেলনি তো?
বৈঠকখানায় রেখেছি, তাকের ওপর। কিন্তু কেন? তার গলার বিস্ময়।
মিসেস হোয়াইট কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি হেসে উঠলেন। নিচু হয়ে স্বামীর গালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন।
প্রলাপের মতো বললেন, আমার কেবল এখনই মনে পড়ল। আগে কেন মনে পড়েনি? হা গো, তোমার কেন আগে এ কথা মনে হয়নি?
কীসের কথা তুমি বলছ? তিনি প্রশ্ন করলেন।
কেন বাকি দুটি ইচ্ছের কথা? আমাদের তো কেবল একটি ইচ্ছে পূরণ । হয়েছে।
মি. হোয়াইট রেগে বললেন, যা হয়েছে, তা-ই কি যথেষ্ট নয়?
না, জোর গলায় বললেন মিসেস হোয়াইট । আমাদের আরো একটা। ইচ্ছে রয়েছে। নিচে যাও। থাবাটা নিয়ে এসো। আর সেটা হাতে নিয়ে বলো, আমাদের বাছা আবার বেঁচে উঠুক।
মি. হোয়াইট বিছানায় উঠে বসলেন। চাদরটা গা থেকে ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, ওহ গড, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
নিয়ে এসো ওটা। শিগগির নিয়ে এসো। হাতে নিয়ে তোমার ইচ্ছের কথা বলো। আহারে বাছা আমার, বললেন মিসেস হোয়াইট।
মি. হোয়াইট দেশলাই জ্বেলে বাতি ধরালেন। গলায় জোর পেলেন না। তবু তিনি বললেন, বিছানায় চলে এসো। তুমি কী বলছ নিজেই বুঝতে পারছ না।
আমাদের প্রথম ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয়টা পূরণ হবে না কেন? যেন ঘোরের মধ্যে বললেন মিসেস হোয়াইট।
মি. হোয়াইট শুধু বলতে পারলেন, ওটা ঘটে গেছে কাকতালীয়ভাবে।
যাও ওটা নিয়ে এসো, তোমার ইচ্ছের কথা বলো, চিৎকার করে বললেন মিসেস হোয়াইট। স্বামীকে দরজার দিকে ঠেলে দিলেন তিনি।
মি. হোয়াইট অন্ধকারে নিচে নামলেন। হাতড়ে হাতড়ে পৌঁছে গেলেন বৈঠকখানায়। তারপর সেই তাকে। থাবাটি সেখানেই ছিল। তাঁর ভীষণ ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল ঘর থেকে বেরুবার আগেই হয়তো দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত চেহারা নিয়ে তাঁর ছেলে সামনে এসে হাজির হবে। তিনি কাঁপছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন দরজায় যাবার পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। ভ্রুতে ঘাম জমেছে। টেবিলের চারদিকে ঘুরে দেয়াল ধরে ধরে তিনি বাইরে এলেন। হাতে সেই অস্বস্তিকর জিনিসটা।
তিনি ঘরে ঢুকলেন। তাঁর স্ত্রীর মুখের চেহারাই যেন পালটে গেল । মি. হোয়াইটের চোখেমুখে ভয়। তিনি দেখলেন তার স্ত্রী অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে থাবাটির দিকে তাকিয়ে আছেন।
মিসেস হোয়াইট শক্ত গলায় বললেন, তোমার ইচ্ছার কথাটা বলো।
এটা ঠিক হচ্ছে না, বোকর মতো কাজ হচ্ছে, কথাটা যেন মি. হোয়াইটের গলায় আটকে গেল।
বলো তুমি, ফের বললেন মিসেস হোয়াইট।
মি. হোয়াইট হাতখানা তুলে ধরলেন। তারপর চিৎকার করে বললেন, আমার ছেলে আবার বেঁচে উঠুক।
থাবাটা মেঝেতে পড়ে গেল। ভয়ে শিউরে উঠে মি. হোয়াইট থাবাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একসময় কাঁপতে কাঁপতে তিনি চেয়ারের মধ্যে ডুবে গেলেন। আর তাঁর স্ত্রী জ্বলন্ত এক জোড়া চোখ নিয়ে জানালার এক ধারে এসে দাঁড়ালেন। টেনে খুলে নিলেন পর্দাটা।
মি. হোয়াইট বসে রইলেন। ঠাণ্ডায় যেন জমে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন স্ত্রীর আবছা চেহারার দিকে। মিসেস হোয়াইটের দৃষ্টি জানালার বাইরে। বাতির আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। একটা ভৌতিক ছায়া পড়ছিল সিলিং আর ছাদের ওপর। হঠাৎ দপ করে বাতিটা নিভে গেল। মি. হোয়াইট হাঁফ ছেড়ে বাচলেন।
না, থাবাটা এবারে আর কাজ দিল না। তিনি বিছানায় ফিরে এলেন। দুএক মিনিট পরে ধীর পায়ে বিছানায় এলেন মিসেস হোয়াইটও। পাশে শুয়ে পড়লেন উদাসীনভাবে।