একটা গুদাম ঘরে স্বল্প বেতনে কাজ করত বাপ। ও দিয়ে সংসার চলত না। তারপর একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। অনেকদিন অসুস্থ ছিল বলে চাকরিটাও হারায়। ওই গুমোট ঘরে দিনের পর দিন স্ত্রীর গঞ্জনা আর ক্ষুধার্ত বাচ্চার কান্না সহ্য করতে হয়েছে তাকে অসুস্থ শরীরে। আমি এ সমস্ত তথ্য পেয়েছি প্রতিবেশিদের কাছ থেকে। শুনেছি ভয়ানক দুঃসময় যাচ্ছিল ওদের। এত দারিদ্র সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠেছিল বেকার বাপের জন্য।
তারপর একদিন খুব ভোরে, ওই বাড়ির নীচতলার এক মহিলা দেখতে পায় তার জানালার পাশ দিয়ে কী যেন একটা উপর থেকে পড়ল। পরক্ষণে দড়াম করে শব্দ, মহিলা বাইরে এসে দেখে চিলেকোঠার পরিবারের ছেলেটি পড়ে আছে মাটিতে। ক্রিস্টিনকে জড়িয়ে রেখেছে সে। ছেলেটির ঘাড় ভেঙে গেছে। মারা গেছে সে।
মহিলার ডাকাডাকিতে ওই বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দারা জেগে ওঠে। পুলিশ আর ডাক্তারকে খবর দিয়ে তারা চিলেকোঠায় যায়। ভেতর থেকে তালা বন্ধ দরজা ভেঙে ঢুকতেই তীব্র গ্যাসের গন্ধ ধাক্কা মারে তাদের নাকে। যদিও জানালা খোলা ছিল। স্বামী আর স্ত্রীকে বিছানায় মৃত পড়ে থাকতে দেখে তারা। স্বামী একটা চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিল :
আমি আর পারলাম না। আমার পরিবারকে খুন করতে যাচ্ছি আমি। এ ছাড়া কোন রাস্তা নেই।
পুলিশ বলেছিল পুরুষ লোকটা পরিবারের সবাই যখন ঘুমাচ্ছিল ওই সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে গ্যাস চালিয়ে দেয়। তারপর শুয়ে পড়ে স্ত্রীর পাশে এবং অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ছেলেটি যেভাবে হোক জেগে গিয়েছিল। দরজা খোলার চেষ্টাও বোধহয় করেছিল। দুর্বল শরীরে পারেনি। শেষে জানালা খুলে নিচে লাফিয়ে পড়ে আদরের বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
এক বছর বয়সী ক্রিস্টিন কেন গ্যাসে আক্রান্ত হয়নি এটা একটা রহস্য। হয়তো বেডক্লথ দিয়ে মাথা ঢাকা ছিল তার। ভাইয়ের বুকের সাথে মাথা চেপে ঘুমিয়েছে-ভাইয়ের সঙ্গেই ঘুমাত সে। যাহোক, বাচ্চাটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে এই হোমে। এখানে আপনি আর জিম সাহেব ওকে প্রথম দেখলেন…নিঃসন্দেহে ওটা সৌভাগ্যের দিন ছিল ক্রিস্টিরে জন্য।
ওর ভাই তাহলে বোনকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছে? বললাম আমি।
হ্যাঁ। খুব সাহস ছিল ছেলেটার।
কী নাম ছিল ভাইয়ের?
দেখছি, ফাইলের স্তূপ থেকে একটা ফাইল বের করলেন মিসেস ক্লিভার। চোখ বুলাতে লাগলেন। অবশেষে বললেন, পরিবারটির নাম। জোনস পরিবার। আর চোদ্দ বছরের ছেলেটির নাম ছিল হ্যারি জোনস।
তার মাথায় কোঁকড়ানো লাল চুল ছিল? বিড়বিড় করলাম আমি।
তা বলতে পারব না, মিসেস জেমস।
কিন্তু ওটা হ্যারি। ছেলেটার ডাকনাম হ্যারি। কিন্তু এর অর্থ কী? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
অর্থ আমিও বুঝতে পারছি না। তবে আমার ধারণা ক্রিস্টিনের মনের গভীর অবচেতনে হ্যারির স্মৃতি রয়ে গেছে। তার শৈশবের সাথী। আমরা ভাবি শিশুদের স্মৃতিশক্তি তেমন প্রখর নয়, কিন্তু অতীতের অনেক কথাই তাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে। ক্রিস্টিন এই হ্যারিকে আবিষ্কার করেনি, এর স্মৃতি তার মনে পড়ে যাচ্ছে। তাই তাকে সে একটা জ্যান্ত রূপ। দিয়েছে। আমার কথা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই এমন অদ্ভুত যে অন্য কোন ব্যাখ্যা মাথায় আসছে না।
ওরা যে বাড়িতে থাকত সেটার ঠিকানা পেতে পারি?
মিসেস ক্লিভার ঠিকানা দিতে রাজি নন। কিন্তু আমার পীড়াপীড়িতে শেষে দিতেই হলো। আমি ১৩, কানভাররোর ঠিকানা খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। অবশেষে বাড়িটি খুঁজে পেলাম। শহরের শেষ মাথার বাড়িটি জনমানবশূন্য মনে হলো। নোংরা এবং ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। তবে একটা দৃশ্য দেখে থমকে গেলাম। ছোট একটা বাগান আছে বাড়ির সামনে। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবুজ ঘাস। তবে ছোট্ট বাগানের এক জায়গার অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য গ্রাস করতে পারেনি বিষণ্ণ রাস্তার পাশের বাড়িগুলো-সাদা গোলাপের একটা ঝাড়। ঝলমল করছে গোলাপগুলো। চমৎকার সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।
ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে চিলেকোঠার জানালার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি।
একটা কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলাম, এইহানে কী চান?
নিচতলার জানালা দিয়ে উঁকি মেরেছে এক বুড়ি। মাথায় শনের মত সাদা চুল। পরনে ময়লা, ছেঁড়া কাপড়।
ভেবেছিলাম বাড়িটি খালি, বললাম আমি।
খালি থাকবারই কতা ছিল। এইহানে আমি ছাড়া কেউ থাহেও না। আমারে ওরা বাইর করবার পারে নাই। আমার কোতাও যাইবার জায়গা নাই। ঘটনা ঘটবার পর অন্য মাইনষেরা ভয় পাইয়া বাড়ি ছাইড়া পালায়। তারপর আর কেউ এই বাড়ি ভাড়া লইবার আয় নাই। এইটা বলে হানাবাড়ি।
একটু বিরতি দিল সে। তারপর লাল টকটকে চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল। আমি ওরে আমার জানলার পাশ দিয়া ছিটকা পইড়া যাইতে দেখছি। ঐ যে গোলাপ ঝাড়টা দেখছেন, ঐহানে পইড়াছিল সে ঘাড় মটকাইয়া। তয় ও এহনও ফিরা আসে। আমি অরে দেখতে পাই। বইনরে না পাওয়া পর্যন্ত সে কোথাও যাইব না।
শিউরে উঠি আমি। কে-কার কথা বলছেন আপনি?
বুড়ি বলল, হ্যারি। মাথা ভর্তি কোঁকড়াইন্যা লাল চুল। শুটকা। খুব জিদ্দি। তয় পোলাড়া খুব ভাল আছিল। বইনডারে জান দিয়া ভালবাসত। ঐ গাছের ধারে ছোড বইনরে নিয়া খেলত। মরছেও ঐহানেই। কিন্তু সত্যই কি মরছে?