তুমি ক্লান্ত,মা। চলো, ঘুমাতে যাবে।
মুখে জলের শুকনো দাগ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ক্রিস্টিন।
তখনও দিনের আলো ছিল। আমি জানালার ধারে গেলাম পর্দা ফেলে দিতে। বাগানে সোনালি ছায়া আর রোদের লম্বা ফালি। তারপর, আবার স্বপ্নের মত, সাদা গোলাপ ঝাড়ের পাশে ছায়া ফেলল লম্বা, পাতলা একটি শরীর। পাগলিনীর মতো ঝট করে জানালা খুলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, হ্যারি! হ্যারি!
কোঁকড়ানো চুলের মাথাসহ ছায়াটা দেখলাম যেন এক মুহূর্তের জন্য। তারপর আর কিছু নেই।
রাতে জিমকে ক্রিস্টিনের কথা বললাম। সহানুভূতির ভঙ্গিতে মাথা দোলাল সে। বেচারী। স্কুলে যাবার সময় সব বাচ্চাই এরকম কান্নাকাটি করে। একবার স্কুলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন পরে আস্তে আস্তে হ্যারির কথাও ভুলে যাবে।
হ্যারি চায় না ও স্কুলে যাক।
অ্যাই! তুমিও দেখছি হ্যারিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছ।
কখনও কখনও করি।
বুড়ো বয়সে ভূত–প্রেতে বিশ্বাস? ঠাট্টা করল জিম।
হ্যারি ভূত–প্রেত নয়, বললাম আমি। একটা কিশোর মাত্র। যার কোন অস্তিত্ব নেই শুধু ক্রিস্টিরে কাছে ছাড়া। আর ক্রিস্টিন কে?
ওভাবে বলছ কেন? কঠিন শোনাল জিমের কণ্ঠ। ক্রিস্টিনকে দত্তক নেয়ার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ও আমাদের আপন সন্তানের মতো বেড়ে উঠবে। আমরা ওর অতীত নিয়ে মাথা ঘামাব না। কোন দুশ্চিন্তা করব না। কোন রহস্য নিয়ে ভাবব না। আমরা ভাবব ক্রিস্টিন আমাদের রক্ত মাংসের সন্তান। অথচ তুমি এখন প্রশ্ন তুলছ ক্রিস্টিন কে! ও আমাদের মেয়ে-এ কথাটা ভুলে যেয়ো না।
জিমকে আগে কখনও এভাবে রেগে উঠতে দেখিনি। তাই পরদিন ক্রিস্টিন স্কুলে থাকার সময় কী করব সে ব্যাপারটা গোপন করে গেলাম ওর কাছে।
পরদিন সকালে ক্রিস্টিনকে চুপচাপ আর গম্ভীর দেখলাম। জিম ওর সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করে মন ভালো করে দিতে চাইল। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তারপর একসময় বলল, হ্যারি ভাইয়া চলে গেছে।
হ্যারিকে তোমার দরকার নেই। তুমি এখন স্কুলে যাবে। বলল জিম।
ক্রিস্টিন ওর দিকে সেই ঘৃণামিশ্রিত বড়দের মতো চাউনি দিল।
স্কুলে যাবার পথে মেয়ের সঙ্গে কোন কথা হলো না আমার। খুব কান্না পাচ্ছিল। তবু যে ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে পারছি তাই যথেষ্ট। ওকে আমি হারিয়ে ফেলছি এরকম বিচিত্র অনুভূতি জাগল মনে। প্রতিটি মায়েরই হয়তো তার বাচ্চাকে প্রথম স্কুলে নিয়ে যাবার সময় এরকম অনুভূতি হয়। স্কুলে ভর্তি হওয়া মানে শিশুর শৈশবকালের সমাপ্তি, বাস্তব জীবনে প্রবেশ। জীবনের নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, অচেনা দিকের সাথে পরিচয়। স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ওকে বিদায় চুম্বন করে বললাম, তুমি আজ স্কুলের অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে, ক্রিস। তিনটার সময় ছুটি হলে তোমাকে নিতে আসব।
আচ্ছা, মাম্মি, আমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ও। নার্ভাস চেহারায় অন্যান্য বাবা-মাদের সাথে ভয় আর দুশ্চিন্তা নিয়ে বাচ্চারা স্কুলে আসতে শুরু করেছে। সুন্দর চুলের, সাদা সুতির স্কার্ট পরা এক সুন্দরী তরুণী হাজির হলো স্কুল গেটে। নতুন বাচ্চাদের জড়ো করে ওদের নিয়ে। স্কুল অভিমুখে রওনা হয়ে গেল। আমার সামনে দিয়ে যাবার সময় তার মুখে সহানুভূতির হাসি ফুটল। আমরা ওর ঠিক মতো যত্ন নেব।
ক্রিস্টিনকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না জেনে হালকা হয়ে গেল মন। এবার আমার গোপন অভিযানে বেরিয়ে পড়া চলে। বাসে উঠে পড়লাম। নামলাম বিশালাকৃতির, বিষণ্ণ চেহারার বিল্ডিংটির সামনে। চার বছর আগে জুবেরকে নিয়ে একবার এসেছিলাম এ দালানে। এরপর আর আসার দরকার হয়নি। বিল্ডিং-এর টপ ফ্লোরে গ্ৰেথর্ন অ্যাডপশন সোসাইটির অফিস। আমি পাঁচতলায় উঠে এলাম। রঙচটা, পরিচিত দরজায় কড়া নাড়লাম। এক মহিলা, আগে কখনও দেখিনি, ভিতরে আসতে বলল আমাকে। মিসেস ক্লিভারের সাথে দেখা করতে পারি? আমি মিসেস জেমস।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
না। তবে ব্যাপারটা খুব জরুরি।
আচ্ছা, দেখছি। বলে ভিতরের ঘরে ঢুকল সে। একটু পরেই ফিরে এল।
মিসেস ক্লিভার আপনাকে যেতে বলেছেন, মিসেস জেমস।
মিসেস কিভার রোগা, লম্বা, ধূসর চুলের হাসি মুখের এক মহিলা। তাঁর চেহারা থেকে করুণা ঝরে পড়ছে, কপালে অসংখ্য ভাঁজ। আমাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মিসেস জেমস, কতদিন পরে দেখা! ক্রিস্টিন কেমন আছে?
ভাল আছে, মিসেস ক্লিভার। আপনার সময় নষ্ট না করে সরাসরি কাজের কথায় চলে আসি। আমি জানি দত্তক সন্তানদের জন্মবৃত্তান্ত আপনারা গোপন রাখেন। কিন্তু ক্রিস্টিনের আসল পরিচয় জানা আমার খুবই দরকার।
দুঃখিত, মিসেস জেমস, শুরু করলেন তিনি। আমাদের নিয়ম আছে…
প্লীজ, গল্পটা আগে শুনুন। তারপর বুঝতে পারবেন কেন ক্রিস্টিনের জন্ম নিয়ে তথ্য চাইছি।
হ্যারির ঘটনা বললাম তাঁকে।
সব শুনে তিনি মন্তব্য করলেন, খুব অদ্ভুত ঘটনা। খুবই অদ্ভুত। মিসেস জেমস, এই প্রথম আমি নিয়ম ভাঙছি। ক্রিস্টিনের জন্ম শহরতলীর এক হত দরিদ্র এলাকায়। ওদের সংসারে ছিল চার সদস্য, বাবা, মা, ভাই ও ক্রিস্টিন।
ভাই?
হ্যাঁ। তার যখন চোদ্দ বছর তখন ঘটনাটা ঘটে।
কী ঘটেছিল?
গোড়া থেকে বলি। বাবা-মা ক্রিস্টিনের জন্ম হোক তা চায়নি। তিনতলা একটা জরাজীর্ণ বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার ঘিঞ্জি ঘরে গাদাগাদি করে বাস করত গোটা পরিবার। ওখানে অতি স্বল্প আয়ের লোকজন বাড়ি ভাড়া করে থাকত। সেই ভবনের চিলেকোঠার ঘরে তিনজনেরই ঠিক মতো শোয়ার জায়গা হত না, আর একটা বাচ্চা যোগ হওয়ায় খুবই মুশকিলে পড়তে হয়েছিল ক্রিস্টিরে বাবা-মাকে। মা-টা ছিল পাগলাটে টাইপের, মোটাসোটা, নোংরা আর অত্যন্ত অসুখী একজন মানুষ। মেয়ের প্রতি তার কোন আগ্রহই ছিল না। তবে ভাইটি প্রচণ্ড ভালবাসত তার বোনকে। স্কুল বাদ দিয়ে বোনের দেখাশোনা করত।