মনে আছে। বলল ক্রিস্টিন। সোৎসাহে পা বাড়াল ডাক্তারের চেম্বারের দিকে। আমি অস্থিরচিত্তে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওদের অস্পষ্ট গলা ভেসে আসছে। ডাক্তার খিক খিক করে হাসলেন। ক্রিস্টিন জোর হাসিতে ফেটে পড়ল। ডাক্তারের সাথে যেরকম আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছে আমার সঙ্গে সেভাবে কখনও বলে না।
ওরা ঘর থেকে বেরুল। ডাক্তার বললেন, আপনার মেয়ের কোন সমস্যা নেই। ওর মনটা শুধু কল্পনায় ভরা। একটা কথা মিসেস জেমস, ওর সঙ্গে হ্যারির ব্যাপারে আলোচনা করুন। আপনার উপরে যেন সে আস্থা রাখতে পারে। আপনি ওর এই ভাইটির ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন, শুনেছি আমি। তাই ক্রিস্টিন হ্যারি সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। হ্যারি কাঠের খেলনা বানাতে পারে, তাই না, মামণি?
হ্যাঁ। হ্যারি ভাইয়া কাঠের খেলনা বানাতে পারে।
সে লিখতে পড়তেও জানে, না?
হ্যাঁ। এছাড়া সাঁতার কাটতে পারে, গাছে চড়তে পারে, ছবি আঁকে। হ্যারি ভাইয়া সব পারে। ও খুব ভাল ভাই। ক্রিস্টিনের ছোট্ট মুখখানা জ্বলজ্বল করে উঠল।
ডাক্তার আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন। হ্যারি ওর কাছে খুব ভালো একটা ভাই। ক্রিস্টিনের মত তার চুলের রঙও লাল, তাই না?
হ্যারি ভাইয়ার চুল আমার চেয়েও লাল আর কোঁকড়ানো। ড্যাডির মতোই প্রায় লম্বা তবে একটু শুকনা। গর্বের সুর ক্রিস্টিনের কণ্ঠে। মাম্মি, তোমার সমান লম্বা হ্যারি ভাইয়া। ওর বয়স চোদ্দ। বলেছে বয়সের তুলনায় ও নাকি বেশি লম্বা হয়ে গেছে। এ কথার মানে কী?
বাড়ি যাবার পথে মাম্মি তোমাকে এ কথার মানে বুঝিয়ে দেবেন বললেন ডা.ওয়েবস্টার। এখন বিদায়, মিসেস জেমস। দুশ্চিন্তা করবেন না। ও আবোল তাবোল যা বলে বলুক। গুডবাই, ক্রিস্টিন। হ্যারিকে আমার ভালবাসা দিয়ো।
ও তো ওখানে, ডাক্তারের বাগানের দিকে আঙুল তুলে দেখাল ক্রিস্টিন। আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
গলা ছেড়ে হাসলেন ডাক্তার। এদেরকে সংশোধন করা সম্ভব নয়, তাই না? আমি এক আদিবাসী মায়ের কথা জানি যার বাচ্চারা কল্পনায় গোটা একটি আধিবাসী দল আবিষ্কার করে বাড়িতে নানারকম পূজা-অর্চনা শুরু করে দিয়েছিল। সেদিক থেকে আপনি ভাগ্যবতী, মিসেস জেমস!
নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। মনে প্রাণে আশা করলাম ক্রিস্টিন স্কুলে যেতে শুরু করলে তার মাথা থেকে হ্যারির ভূতটা নেমে যাবে।
ক্রিস্টিন আমার আগে আগে ছুটে চলেছে। এমনভাবে পাশ ফিরে তাকাচ্ছে যেন সঙ্গে কেউ আছে। একটি ভয়ঙ্কর সেকেন্ডের জন্য আমি ফুটপাতে ওর ছায়ায় পাশে আরেকটি লম্বা, সরু ছায়া দেখতে পেলাম–কোঁকড়ানো চুলের মাথার কোন ছেলের ছায়া। পরের মুহূর্তে ওটা উধাও। ছুটে গিয়ে ক্রিস্টিনের হাত চেপে ধরলাম। বাকি রাস্তাটা আর মুঠো ছাড়লাম না।
আমাদের বাড়িটিতে যথেষ্ট নিরাপত্তা রয়েছে। কিন্তু এ গরমেও বাড়িটি আশ্চর্য রকম ঠান্ডা। আমি আর এক মুহূর্তের জন্যও ক্রিস্টিনকে চোখের আড়াল হতে দিলাম না। ও আমার চোখের সামনেই আছে, কিন্তু বাস্তবে যেন আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমার বাড়িতে আমার বাচ্চা ক্রমে অচেনা একজনে পরিণত হচ্ছে।
ক্রিস্টিনকে দত্তক নেওয়ার পরে এই প্রথম সিরিয়াসভাবে প্রশ্নগুলো মাথায় এল আমার : কে ও? কোত্থেকে এসেছে ও? ওর আসল বাবা-মা
কে? যাকে আমি মেয়ে হিসেবে হিসেবে দত্তক নিয়েছি এর প্রকৃত পরিচয় কী? কে ক্রিস্টিন?
আরেকটি হপ্তা গেল। সারা হপ্তা শুধু হ্যারির গল্পই শুনতে হলো। স্কুলে যাবার আগের দিন ক্রিস্টিন জানাল সে স্কুলে যাবে না।
অবশ্যই যাবে। বললাম আমি। তোমার স্কুলে ভর্তি হবার বয়স হয়েছে। ওখানে তোমার বয়সী অনেক বন্ধু পাবে।
হ্যারি ভাইয়া বলেছে সে যেতে পারবে না।
স্কুলে হ্যারিকে দরকার হবে না তোমার। সে– ডাক্তারের উপদেশ মনে পড়ে গেল, অনেক কষ্টে গলার স্বর শান্ত রাখলাম। –মানে স্কুলে ভর্তি হবার জন্য তার বয়স অনেক বেশি। ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্যে চোদ্দ বছরের একটা বুড়ো ছেলের খুবই অস্বস্তি লাগবে।
আমি হ্যারি ভাইয়াকে ছাড়া স্কুলে যেতে পারব না। আমি হ্যারি ভাইয়ার সঙ্গে থাকব। ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল ও। ক্রিস, কান্না বন্ধ করো! বন্ধ করো বলছি! ঠাস্ করে ওর হাতে সজোরে চড় বসিয়ে দিলাম। সাথে সাথে থেমে গেল কান্না। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। বড় বড় নীল চোখ জোড়া বিস্ফারিত এবং ভয়ঙ্কর ঠান্ডা। বড়দের মতো ভীতিকর চাউনি। ছমছম করে উঠল গা।
ক্রিস্টিন বলল, তুমি আমাকে ভালবাস না। হ্যারি ভাইয়া আমাকে ভালবাসে। ও আমাকে চায়। বলেছে ওর সঙ্গে আমি যেতে পারি।
এসব কথা আমি আর শুনতে চাই না!
চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, পরক্ষণে নিজের উপরে রাগ হলো ছোট একটা বাচ্চার সাথে এরকম খারাপ ব্যবহার করার জন্য। আমার বাচ্চা হাঁটু–গেড়ে বসে পড়লাম আমি। দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে ব্যাকুল গলায় ডাকলাম, ক্রিস, সোনা। এসো।
ধীর পায়ে এগিয়ে এল সে। আমি তোমাকে ভালবাসি। বললাম আমি। তুমি স্কুলে গেলে আমি খুব খুশি হবো।
স্কুলে গেলে হ্যারি ভাইয়াকে পাব না।
অন্য অনেক বন্ধু পাবে।
আমি অন্য কাউকে চাই না। শুধু হ্যারি ভাইয়াকে চাই। আবার চোখ ছাপিয়ে জল এল। আমার কাঁধে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে। আমি ওকে জোরে জড়িয়ে ধরলাম।