দুধ খাওয়া শেষ হলে আমি বললাম, আমরা এখন শপিং করতে যাব, ক্রিস। আমার সঙ্গে যাবে?
না। আমি হ্যারি ভাইয়ার সঙ্গে থাকব।
তা হবে না। তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছ।
হ্যারি ভাইয়া যেতে পারবে?
না।
চুল আঁচড়ানোর সময় লক্ষ করলাম আমার হাত কাঁপছে। আজকাল ভীষণ ঠান্ডা লাগছে ঘরে। যেন শীতল একটা ছায়া ঘিরে আছে বাড়িটাকে সূর্যালোক আড়াল করে। সুবোধ বালিকাটির মতো আমার সাথে বেরিয়ে পড়ল ক্রিস্টিন। তবে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ঘুরে হাত নাড়ল সে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে।
এ ঘটনা জিমকে জানালাম না আমি। বললে আগের দিনের মতো লেকচার শুনিয়ে দেবে সে আমাকে। কিন্তু ক্রিস্টিনের হ্যারি ভাইয়ার ফ্যান্টাসী দিনের পর দিন চলতে লাগল, সেই সাথে চাপ বাড়ল আমার। স্নায়ুতে। গ্রীষ্মের লম্বা দিনগুলো এখন আমার চোখে বিষের মতো, চাতকের মত অপেক্ষা করছি ধূসর মেঘভর্তি আকাশ আর বৃষ্টির জন্য। বাগানে ক্রিস্টিনের গলা শুনলেই আজকাল কেঁপে উঠি আমি। হ্যারি ভাইয়ার সাথে সে বিরামহীন বকবক করে চলে।
এক শুক্রবারে জিম সবকিছু শোনার পরে মন্তব্য করল, আমি তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি কল্পনায় ও তার একজন সঙ্গী খুঁজে নিয়েছে।
ওর ভাষাও বদলে যাচ্ছে, বললাম আমি। খানিকটা আঞ্চলিক টানে কথা বলে। খাইয়াম, দিবাম ইত্যাদি।
লন্ডনের প্রতিটি বাচ্চাই আঞ্চলিক টানে কথা বলে। কেউ কম, কেউ বেশি। স্কুলে যাবার পরে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে মিশে তো ওর উচ্চারণ আরও বাজে হয়ে উঠবে।
আমরা তো এভাবে কথা বলি না। এরকম উচ্চারণ ও শিখল কোত্থেকে? আর কার থেকে ও এ উচ্চারণ শিখবে ওই ইয়েটা ছাড়া..হ্যরির নামটা মুখে এল না আমার।
দুধঅলা, দারোয়ান, ক্লিনার-আরও নাম শুনতে চাও?
চাই না, তিক্ত একটা হাসি দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম আমি।
তবে, বলল জিম। আমি কিন্তু ওর উচ্চারণে কোন টানের প্রভাব লক্ষ করিনি।
আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সে ওভাবে উচ্চারণ করেও না। শুধু বলে ওর-ওর সঙ্গে কথা বলার সময়।
অর্থাৎ হ্যারি। এই হ্যারির ব্যাপারে আমার বেশ কৌতূহল হচ্ছে। চলো, একদিন খুঁজে দেখি সত্যি এ নামে কেউ আছে কিনা?
না! আর্তনাদ করে উঠলাম আমি। ও কথা আর মুখেও এনো না। ওটা আমার দুঃস্বপ্ন। আমার জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। ওহ্। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
বিস্মিত দেখাল ওকে। এই হ্যারি দেখছি তোমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে!
আসলেই তাই। সারা দিনরাত আমাকে অনর্গল শুনতে হচ্ছে হ্যারি ভাইয়া ওটা, হ্যারি ভাইয়া এটা, হ্যারি ভাইয়া অমুক বলেছে?
হ্যারি ভাইয়া তমুক ভাবছে। হ্যারি ভাইয়াকে এটা দিই?
হ্যারি ভাইয়াকে নিয়ে আসি? তুমি অফিসে থাকো বলে এ যন্ত্রণা তোমাকে সইতে হয় না। কিন্তু এটার সঙ্গে আমাকে বাস করতে হচ্ছে। আমি আমি ভয় পাচ্ছি, জিম। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর।
তোমার মানসিক বিশ্রামের জন্য কী করা দরকার জানো?
কী?
ক্রিসকে নিয়ে কাল ডা. সালামের কাছে যাবে। উনি এ শহরের সেরা সাইকিয়াট্রিস্ট। ক্রিসের সাথে উনি কথা বলুন।
ক্রিস কি অসুস্থ–মানে মানসিক ভাবে…?
আরে না! তবে প্রফেশনাল অ্যাডভাইসটা এখন দরকার।
পরদিন ক্রিস্টিনকে নিয়ে গেলাম ডা. ওয়েবস্টারের কাছে। ওকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে ডাক্তারের কাছে হ্যারির ব্যাপারটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলাম। সহানুভূতির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন তিনি, তারপর বললেন, এটা একটা অদ্ভুত কেস, মিসেস জেমস। তবে অস্বাভাবিক নয়। কাল্পনিক সঙ্গী কোন কোন বাচ্চার কাছে এমন বাস্তব হয়ে ওঠে যে বাবা মার আত্মা শুকিয়ে যায় ভয়ে। এরকম ঘটনা বহু দেখেছি। আপনার মেয়েটি বোধহয় একা থাকে, তাই না?
ওর কোন বন্ধু নেই। আমরা নতুন এসেছি ওই এলাকায়। তবে স্কুলে যেতে শুরু করলে আর বন্ধুর অভাব হবে না।
ও স্কুলে যাবার পরে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে যখন মিশতে থাকবে, দেখবেন ফ্যান্টাসিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রতিটি শিশুরই সমবয়সী সঙ্গী সাথী দরকার। না পেলে সে নিজেই কোন সঙ্গী আবিষ্কার করে বা বানিয়ে নেয়। বয়সী কিংবা বুড়োরা যেমন আপন মনে নিজেদের সাথে কথা বলে। এর মানে এই নয় যে তারা পাগল। কারও সঙ্গে কথা বলার দরকার হয়। বলেই এমনটা করে। শিশুরা আরও বেশি প্র্যাকটিকাল। নিজে নিজে কথা বলার চেয়ে কল্পনায় কোন সঙ্গী সে তৈরি করে। আমার মনে হয় না এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু আছে।
আমার স্বামীও তাই বলেছে।
ঠিকই বলেছেন তিনি। তবে ক্রিস্টিনকে যেহেতু নিয়ে এসেছেন, ওর সঙ্গে একটু কথা বলি। তবে আমাদের আলাপচারিতায় আপনার না থাকলেও চলবে।
আমি ওয়েটিংরুমে গেলাম ক্রিস্টিনের কাছে। সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল, হ্যারি ভাইয়া অপেক্ষা করছে।
কোথায়, ক্রিস? শান্ত গলায় প্রশ্ন করলাম।
ওই তো। গোলাপের ঝাড়ের ধারে।
ডাক্তার তার বাগানে গোলাপ ঝাড় বানিয়েছেন। তাঁর বাসা এবং চেম্বার একসাথে।
ওখানে কেউ নেই। বললাম আমি। ক্রিস্টিন কটমট করে তাকাল আমার দিকে। ডা. ওয়েবস্টার তোমার সাথে কথা বলবেন, সোনা। ওর চাউনিতে এমন কিছু একটা ছিল, কথা বলার সময় গলা কেঁপে গেল আমার। ওনাকে তো তুমি চেনোই। চিকেন পক্স থেকে সেরে ওঠার পরে তোমাকে ক্যাডবেরি খেতে দিয়েছিলেন, মনে নেই?