–ল্যান্স শালওয়ে
হ্যারি
ছোট্ট ছোট্ট জিনিস আমাকে ভীত করে তোলে। রোদ। ঘাসের উপরে গাঢ় ছায়া। সাদা গোলাপ। কোঁকড়ানো লাল চুলের শিশু। আর একটা নাম– হ্যারি। কত সাধারণ একটা নাম!
ক্রিস্টিন যখন প্রথম নামটা বলল আমাকে, আমার গা শিউরে উঠেছিল।
ওর বয়স পাঁচ, মাস তিনেক বাদে ভর্তি হবে স্কুলে। এক সুন্দর, উষ্ণ বিকেলে বরাবরের মতো বাগানে খেলা করছিল ক্রিস্টিন। দেখলাম ঘাসের উপর পেট দিয়ে শুয়ে আছে ও, ফুল ছিঁড়ে মালা গাঁথছে মনের আনন্দে। ওর স্নান লাল চুলে রোদ ঝলসাচ্ছে, ত্বক আশ্চর্য সাদা লাগছে। যেন গোলাপি। একটা আভা ফুটে বেরুচ্ছে শরীর থেকে। বড় বড় নীল চোখ জোড়া গভীর মনোযোগের কারণে ঈষৎ বিস্ফারিত।
হঠাৎ সাদা গোলাপের ঝাড়ের দিকে চোখ তুলে চাইল ক্রিস্টিন। ঝোঁপটার ছায়া পড়েছে ঘাসে। হাসল মেয়েটা।
হ্যাঁ, আমি ক্রিস্টিন, বলল ও। সিধে হলো। ধীর পায়ে হেঁটে এগোল ঝোঁপের দিকে। পরনের নীল সুতির স্কার্টটা উরু ছুঁয়েছে। দ্রুত লম্বা হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।
থাকি মাম্মি আর ড্যাডির সাথে, পরিষ্কার গলা শোনা গেল ওর। তারপর একটু বিরতি দিয়ে, কিন্তু ওরাই আমার মাম্মি আর ড্যাডি।
ঝোঁপের ছায়ার মধ্যে এখন ক্রিস্টিন। যেন আলোর পৃথিবী থেকে ঢুকে পড়েছে আঁধারে। কেমন অস্বস্তি লাগল আমার, জানি না কেন, ডাক দিলাম ওকে।
ক্রিস্টিন, কী করছ তুমি?
কিছু না, অনেক দূর থেকে যেন ভেসে এল কণ্ঠটি।
ঘরে এসো। বাইরে অনেক রোদ।
বেশি রোদ না।
ঘরে এসো, ক্রিস।
ও বলল, আমাকে এখন যেতে হবে। বিদায়, বাড়ির দিকে পা বাড়াল মন্থর ভঙ্গিতে।
ক্রিস, কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
হ্যারি ভাইয়া।
হ্যারি ভাইয়া কে?
হ্যারি ভাইয়া।
ও আর কিছু বলল না। আমি ওকে দুধ খাওয়ালাম, ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত পড়ে শোনালাম বই। শুনতে শুনতে বাগানের দিকে চোখ ফেরাল ক্রিস্টিন। হেসে কাকে যেন উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ল। ওকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পরে স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।
আমার স্বামী জিম বাড়ি ফেরার পরে ওকে রহস্যময় হ্যারি ভাইয়া সম্পর্কে বললাম। হেসেই উড়িয়ে দিল সে আমার কথা।
তোমার সঙ্গে দুষ্টুমি শুরু করেছে ও। বলল জিম।
মানে?
বাচ্চারা কল্পনায় এরকম নানান সঙ্গী-সাথী জোগাড় করে। কেউ কেউ তাদের পুতুলের সঙ্গে কথা বলে। ক্রিস্টিনের তো আবার পুতুল-টুতুলের প্রতি কোন কালেই আগ্রহ ছিল না। ওর ভাই-বোন নেই, নেই সমবয়সী কোন বন্ধু। তাই কল্পনায় একজনকে নিজের সাথী করে নিয়েছে। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই।
কিন্তু নির্দিষ্ট কোন নাম কেন বেছে নেবে ও?
ত্যাগ করল জিম। বাচ্চারা এরকম কত কিছুই তো করে। এ নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কোন মানে হয় না।
না, ঠিক দুশ্চিন্তা নয়। ওর প্রতি আরেকটু খেয়াল রাখার প্রয়োজন বোধ করছি। ওর আসল মায়ের চেয়েও বেশি।
জানি আমি। কিন্তু ক্রিস্টিন ঠিকই আছে। ও চমৎকার একটি মেয়ে। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, বুদ্ধিমতী। এর সমস্ত ক্রেডিট তোমার।
তোমারও।
ইনফ্যাক্ট, আমরা বাবা-মা হিসেবে মন্দ নই।
এবং খুব বিনয়ী। বলে দুজনে হেসে উঠলাম একসাথে। ডজম আমার কপালে চুমু খেল। আমার মন শান্ত হলো ।
তবে পরদিন সকাল পর্যন্ত।
আজও প্রখর রোদ চমকাচ্ছে ছোট বাগানটিতে, সাদা গোলাপ ঝাড়ের গায়ে। ক্রিস্টিন পা মুড়ে বসেছে ঘাসে, চোখ ঝাড়ের দিকে। হাসছে। হ্যালো, বলল সে। জানতাম তুমি আসবে…কারণ তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তোমার বয়স কত? …আমি পাঁচে পা দিয়েছি…আমি বাচ্চা মেয়ে নই। আমি শিগগিরি ইশকুলে ভর্তি হব, নতুন ড্রেস পরব। নীল জামা। তুমি ইশকুলে যাও?…তারপর কী করো? এক মুহূর্ত নিরব থাকল সে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে, শুনছে, আলাপচারিতায় মগ্ন।
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে গা হিম হয়ে এল আমার। বোকার মতো কিছু ভেবে বোসো না। অনেক বাচ্চারই কাল্পনিক সঙ্গী থাকে। নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিছুই ঘটছে না, তুমি কিছুই দেখছ না বা শুনছ না এমন ভাব করলেই হয়। নির্বোধের মতো কিছু করে বোসা না।
কিন্তু আমি ডাক দিলাম ক্রিস্টিনকে দুধ খাওয়ার জন্য। সাধারণত এত তাড়াতাড়ি ওকে দুধ খাওয়াই না আমি।
তোমার দুধ রেডি, ক্রিস। চলে এসো।
এক মিনিট, জবাব শুনে অবাক লাগল। ও দুধ খেতে খুব পছন্দ করে চকলেট ক্রিম বিস্কিট দিয়ে। ডাকলেই চলে আসে।
এখুনি আসো, সোনা, বললাম আমি।
হ্যারি ভাইয়াকে নিয়ে আসি?
না! চিৎকারটা এতই কর্কশ শোনাল যে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।
গুডবাই, হ্যারি ভাইয়া। তোমাকে নিয়ে যেতে পারছি না বলে স্যরি। কিন্তু আমাকে এখন দুধ খেতে যেতে হবে। বলে লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকল ক্রিস্টিন।
হ্যারি ভাইয়াকে কেন দুধ খেতে ডাকলে না? রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে বসল আমার মেয়ে।
হ্যারিটা কে সোনা?
হ্যারি আমার ভাই।
কিন্তু ক্রিস্টিন, তোমার তো কোন ভাই নেই। ড্যাডি আর মাম্মির একটাই মাত্র সন্তান, একটি মাত্র মেয়ে, আর সে হলে তুমি। হ্যারি তোমার ভাই হতে পারে না।
হ্যারি আমার ভাই। ও আমাকে তাই বলেছে। দুধের গ্লাসে মুখ নামাল ও, চুমুক দিল। মুখ তুলল উপরের ঠোঁটে দুধের সাদা রেখা নিয়ে। তারপর থাবা মেরে তুলে নিল বিস্কিট। যাক হ্যারি অন্তত ওর খিদে নষ্ট করতে পারেনি।