সেই থেকেই অ্যান কেমন যেন বদলে গেল। হাসিখুশি চটপটে মেয়েটি ধীরে ধীরে কেমন চুপচাপ, চাপা স্বভাবের মানুষ হয়ে গেল। আমি তাকালেই মুখ ফিরিয়ে নেয়, হাত বাড়ালে সরে যায়। এমন ভাব দেখায় যেন কিছুই হয়নি, যেন জানালায় দেখা নারীর কথায় সে ভুলেই গেছে; কিন্তু আমি তো জানি প্রতিদিন সকালে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই সে। সোজা বাগানে চলে যায়। সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসি তখন সে রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু তার মুখের ক্লান্তি দেখেই আমি বুঝতে পারি সেই নারীকে সে আবার দেখতে পেয়েছে। রাতে বিছানায় সে আমার দিকে পিছন ফিরে শুয়ে অন্ধকারে জেগে থাকে। যখনই জাগি দেখি সে নেই। সে কোথায় গেছে তা নিয়ে এখন আমি ভাবি না। আমি জানি।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে বাধ্য মেয়ের মতোই সে আমার সঙ্গে গেল। কিন্তু ডাক্তার যে ওষুধ খেতে দিল তাতে কোনোই পরিবর্তন হলো না। হয় তো সে ওষুধ সে খায়ইনি। বললাম, চলো এখান থেকে চলে যাই, আর বাড়িটা বিক্রি করে দিই, কিন্তু তার তীব্র আপত্তিতে চুপ করে গেলাম। আম বাগানে গিয়ে কী দেখে সেটা জানবার জন্য দুএকবার বাগানে গিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়েও থেকেছি। সেই নারীকেও দেখতে চেয়েছি। কিন্তু ধূলিমলিন কাঁচের উপর আলো ও গাছপালার ছায়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। কী করব বুঝতে পারছি না। আমার এত ঘনিষ্ঠ সঙ্গিনী স্ত্রী যেন ক্রমেই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
তারপর, একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি ঘর খালি। পিছনের দরজা দিয়ে বাগানে গেলাম। কিন্তু বাগানও জনশূন্য। সে কোথায় গেছে তার কোনো সূত্র যদি পাওয়া যায় এই আশায় বাড়িময় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কোথাও কিছু পেলাম না। টেলিফোনটা বেজে উঠল। ছুটে নিচে গেলাম, নিশ্চয় অ্যান কোনো বান্ধবীর বাড়ি থেকে ফোন করছে, হয়তো সেখানেই ডিনারের জন্য বান্ধবী আটকে দিয়েছে; অথবা শহরে গিয়ে ফিরতে দেরি হয়েছে। কিন্তু টেলিফোন করেছে অন্য লোকে–আমার ভাই; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা শেষ করলাম।
ঘণ্টা বেজেই চলল। আকাশ অন্ধকার হয়ে এল। আবার বাগানে গিয়ে দ্য লরেলস-এর দিকে তাকালাম। হঠাৎ মনে হলো, অ্যান ওখানেই গেছে। ছুটে রান্নাঘরে গেলাম, সেখান থেকে হলে সশব্দে দরজা ও ফটক বন্ধ করে আমাদের বাড়ি ও দ্য লরেলস-এর মাঝখানের কয়েক গজ জায়গা ছুটে পার হয়ে গেলাম। অন্ধকার জানালাগুলো অন্ধের চোখের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাঙা সিঁড়ি ও কাঠ লাগানো দরজায় যাবার পথে বার কয়েক হোঁচট খেলাম। কেন যাচ্ছি, কিসের আশায় যাচ্ছি তাও জানি না। শুধু এটুকু নিশ্চিত জানি যে সে ওই বাড়িতে আছে, আর তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
সামনের দরজাটা খোলা দেখে আমার বিস্মিত হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু আমি অবাক হইনি। দরজাটা কেন খোলা, আর কে খুলেছে সে কথা একবারও না ভেবে ওপাশের অন্ধকার, ধুলোভর্তি হলঘরে ঢুকে পড়লাম। সিঁড়ির ওপরের স্কাই লাইট দিয়ে আসা একটা আবছা আলো হলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরের দুই পাশের বন্ধ দরজাগুলোর দিকে কোনরকম নজর না দিয়েই আমি চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। একবার কান পাতলাম। কিছুই শুনতে পেলাম না। নিস্তব্ধতার একটা শ্বাসরোধকারী কালো কম্বল যেন আমাকে ঘিরে ধরেছে; আমার পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কোথাও নেই। দোতলার চাতালে পৌঁছে একবার থামলাম। তবু কোনো শব্দ নেই। আমার ডান দিকে একটা বারান্দা চলে গেছে; সেটা ধরে এগিয়ে গেলাম।
শেষ প্রান্তে একটা দরজা, তার ফাঁক দিয়ে রূপোলি আলোর একটি রেখা বারান্দায় এসে পড়েছে। থামলাম, আমি জানতাম, অ্যান সেই দরজার অপর দিকে, আর এই প্রথম আমি তাকে ডাকলাম, অ্যান! অ্যান! তুমি কোথায়? কোনো উত্তর এল না। একটা শব্দ পর্যন্ত নেই। ধীরে ধীরে খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ইচ্ছা হলো, ছুটে যাই, এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেলি, অ্যানকে ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে আসি। কিন্তু তার সঙ্গে আর কে আছে তা তো আমি জানি না। দরজার কাছে পৌঁছে আবার থামলাম। আস্তে একটু ধাক্কা দিলাম। দরজাটাও আস্তে ভিতরের দিকে খুলে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা কিছু-একটা মাকড়সার জাল অথবা হাওয়া এসে আমার গালে লাগল। ঘরের মধ্যে তাকালাম। আমার মুখোমুখি একটা জানালা। রঙিন কাঁচের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে তৈরি বিচিত্র পাড় বসানো একটা মস্ত বড় জানালা।
ঘরের মধ্যে অ্যান একা। আর কেউ নেই, কোনো লাল চুলের মেয়ে নয়, কিছু নয়। শুধু অ্যান। ধুলোভর্তি মেঝেতে সে তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে। লম্বা চুলের রাশি তার মুখের উপর ছড়ানো। চুলের গোছা একপাশে সরাতেই দেখলাম সে হাসিমুখেই মারা গেছে।
একটি যুবক দম্পতি আজ বাড়িটা দেখতে এসেছে। আমারই
বয়সী, বরং একটু বেশি লাজুক। বাড়িটা দেখে তারা বেশি কিছু বলল, তবে মনে হলো যে তাদের পছন্দ হয়েছে বাড়ি। পছন্দ হবারই কথা। বাড়িটা ভাল, পরিবেশটাও ভাল। আর কোনোরকম অযৌক্তিক দামও আমি চাইনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িটা বিক্রি করে দিতেই আমি চাই; তাদের শুধু বললাম, এ দামে যদি তারা এর চাইতে ভাল বাড়ি পান তবে তাদের ভাগ্য ভাল বলতেই হবে।
অবশ্য বাগানে দাঁড়িয়ে মেয়েটির আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত মনে হলো। পাশের পুরানো বাড়িটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আমার কাছে জানতে চাইল, ও বাড়িতে কে থাকে। আমি যখন বললাম যে বাড়িটা খালি পড়ে আছে তখন সে ভুরু কুঁচকে বলল, সে শপথ করে বলতে পারে যে দোতলার একটা জানালায় সে কাউকে দেখেছে। মেয়েটার মাথায় লম্বা চুল।