বাড়িতে আসার কয়েক সপ্তাহ পরে ২৪ নম্বরের পাশের বাড়ির দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হলো। এর আগে তারা আমাদের এড়িয়েই গেছে। দুটো বাগানের মাঝখানে বেড়ার দুদিক থেকে মাঝে মধ্যে কিছু কথা হয়েছে মাত্র, কিন্তু কোনো না কোনো ছুতোয় তারা বাড়িতে ঢুকে গেছে। মধ্যবয়সী দম্পতি–তাদের নামটাও জানা হয়নি– শীঘ্রই অবসর গ্রহণে উন্মুখ। একদিন নানা কথায় ভুলিয়ে সেই নাম না জানা মিসেসের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিলাম এবং কথা প্রসঙ্গে ট্যাপলোদের কথাটাও তুললাম।
নামটা শুনেই মিসেসের মুখ কঠিন হয়ে গেল, তবে একটু পরেই অনেকটা সহজভাবেই তাদের সম্পর্কে দুএকটা কথা বলল। অবশ্য নতুন তথ্য বিশেষ কিছু ছিল না। ট্যাপলো দম্পতি খুবই সুবিবেচক প্রতিবেশী ছিল, শান্তশিষ্ট, ভদ্র। কিন্তু কিছুদিন পরেই ট্যাপলোর বউয়ের ব্যবহার কেমন যেন হাস্যকর মনে হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাগানে দাঁড়িয়ে থাকত, বিড়বিড় করত, কাঁদত। আর কিছুদিন পরেই… নাম না জানা মিসেস আর কিছু বলতে চাইল না। চুল্লিতে রান্না চাপিয়ে এসেছে, তক্ষুণি সেটা নামাতে হবে। কিন্তু রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতেই সে বলে গেল, কী লজ্জার কথা, মিসেস ট্যাপলো এমন সুন্দর মেয়ে, লাল চুলো….
এই বাক্যালাপের কথা অ্যানকে জানালাম না। বলা দরকারও মনেও হয়নি। জানালায় দেখা সেই মুখের প্রসঙ্গ যত না ওঠে ততই মঙ্গল। ওটাকে আমরা দুজনেই ভুলে যেতে চাই।
নাম না জানা মিসেসের সঙ্গে কথাবার্তার কয়েকদিন পরে কাজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি অ্যান বাগানে। পুরানো বাড়িটার জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দুই চোখে ভয় ও হতাশা! লক্ষ্য করে আমি চমকে দুজনের জন্য পানীয় নিলাম। অ্যানের শরীর তখন কাঁপছে।
একটু পরে বললাম, তুমি আবার ওকে দেখেছ, তাই না?
হ্যাঁ, সে অস্ফুট গলায় জবাব দিল।
সেই একই মুখ? একই মেয়ে?
হ্যাঁ।
নাম না জানা মিসেসের দেয়া বিবরণ মনে পড়ে গেল, বললাম, মাথায় লাল চুল, তাই না?
হ্যাঁ।… দেখ, আমি খুবই দুঃখিত। … আমি জানি কথাগুলো বোকার মতো শোনাচ্ছে…
আমি জোর গলায় বললাম, না, না, বোকার মতো কেন হবে? ও বাড়িতে নিশ্চয় কেউ বাস করে।
তা কী করে হবে? বাড়ি তো তালাবন্ধ। আর্তস্বরে বলে অ্যান। সে আমার সাহায্য চায়। আমাকে তার দরকার…।
বাজে কথা। তোমাকে তার দরকার হবে কেন?
অ্যান কাঁধ ঝাঁকাল। আমি জানি, সে আমাকে চাইছে।
গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বললাম, বেশ তো, তাহলে চলো, গিয়ে দেখে আসি ব্যাপারটা কী। লাল চুলওয়ালা মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করেই আসি।
অ্যান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। বলল, এটা হয়তো আমার কল্পনা। হ্যাঁ, নিশ্চয় কল্পনা।
বেশ তো, চলো না। ওখানে গিয়ে সন্দেহ মিটিয়ে আসি। বলে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। আমার হাত ধরে সে গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকাল। আমার আচরণ তোমার কাছে হাস্যকর লাগছে না তো? এই সব যা তা দেখা। ভ্রান্তদর্শন।
বললাম, না, আমি মোটেই তা মনে করি না। জানালায় তুমি কাউকে দেখেছ। তার মানে ওখানে কেউ থাকে। আর কোনোরকম সাহায্যের যদি তার দরকার থাকেই তাহলে তো সাহায্য করাই কর্তব্য। চলো।
বাড়িটার নাম দ্য লরেলস। ফটক থেকে সামনের সিঁড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা ভাঙাচোরা ও আগাছায় ভর্তি; ফটকের দশাও তেমন ভালো নয়। পৌঁছে দেখি, সামনের দরজাটা তালাবন্ধ, আর রঙিন কাঁচের পাল্লার উপর তক্তা মেরে দেয়া হয়েছে। জানালায় দেখা নারী যে এই দরজা দিয়ে ঢোকেনি সেটা সহজেই বোঝা যায়। বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। বাগানটা ঝোঁপ জঙ্গলে ভর্তি; এখানে ওখানে আবর্জনার স্তূপ, পরিত্যক্ত বাড়িতে যেরকম হয়ে থাকে। এক তলার জানালাগুলো মজবুতভাবে বন্ধ করা হয়েছে। পিছনের দরজাটাও সামনের দরজার মতোই বন্ধ।
আবার সামনের দরজায় ঘুরে এসে অ্যানের দিকে ফিরে বললাম, দেখ, তোমার সেই রহস্যময়ী বান্ধবীটি এক তলা দিয়ে ঢুকেছে বলে তো মনে হয় না। হয় তো জলের পাইপ বেয়ে উঠে দোতলার জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে।
অ্যান চটে গেল। ঠাট্টা করছ? তুমি তো আগাগোড়াই আমাকে অবিশ্বাস করছ। বেশ তো, তাহলে সবটাই আমার কল্পনা। না হয় আমি মিথ্যা বলেছি। তোমার যা খুশি তাই মনে করতে পার। সে মুখ ঘুরিয়ে রাস্তায় চলে গেল।
তাড়াতাড়ি তার পিছু নিলাম। আমি কী ভাবব বলে তুমি আশা কর? তোমাকে অবশ্যই বিশ্বাস করি। তুমি জানালায় কাউকে দেখেছ। কিন্তু নিজের চোখেই তো দেখলে বাড়িটা বন্ধ। তাহলে সে ঢুকল কোথা দিয়ে?
ততক্ষণে আমরা আমাদের বাড়ির ফটকে পৌঁছে গেছি। অ্যান ফটক খুলে কোনো কথা না বলেই দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। ওর পেছন পেছন হলে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ধীরে ধীরে বললাম, তোমার বিশ্বাস জানালায় কাউকে দেখেছ। কিন্তু ও বাড়িতে কেউ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
অ্যান তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আমি একটা হাঁদা?
আমি জানি না। আমি জানি না। বৈঠকখানায় ঢুকে একটা গ্লাস নিয়ে বসলাম। অ্যান দোতলায় উঠে গেল। সে সন্ধ্যায় আর নিচে নামল না।
অবশ্য রাতে নেমে এল। রাত তিনটে নাগাদ ঘুম ভাঙতে দেখি অ্যান বিছানায় নেই। বাথরুমে নেই, একতলায়ও নেই। গোটা বাড়ির কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। ভয় পেয়ে গেলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম সে কোথায় গেছে। পিছনের শোবার ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে বাগানে তাকালাম। সেখানে চাঁদের আলোয় অ্যান দাঁড়িয়ে আছে; একদৃষ্টিতে পাশের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে।