আবার শুধালাম, ওই বাড়িটা। ওটা কি খালি?
ট্যাপলো আমার দিকে মুখ ফেরাল। ওই বাড়িটা? হ্যাঁ, ওটা খালি। একটু কেশে তাড়াতাড়ি বলল, আপনার স্ত্রীর ভিতরে আসা উচিত। বেশ ঠান্ডা পড়েছে… সে থামল। মৃদু হাসল। অগাস্টের রৌদ্রস্নাত দিনে মোটেই ঠান্ডা ছিল না। সে আবার বলল, আমি দুঃখিত। আপনি যেন কি বলেছিলেন? ও, হ্যাঁ, বাড়িটার কথা। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন, দেয়ালটা খুবই উঁচু; তাছাড়া বাড়িটা শিগগিরই ভেঙে ফেলা হবে; নতুন বাড়ি বানানো হবে।
ট্যাপলোলা বলতে লাগল, অবশ্য তাতে কোনো ক্ষতি হবে না। আধ ডজন আধুনিক ধরনের বাড়ি তৈরি হবে বা ওইরকমই একটা কিছু। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়েই সব কিছু করা হবে। তার চেহারা আগের মতোই নির্বিকার।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। অ্যান তখনও পাশের বাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করলাম। মনে হলো, দোতলার একটা জানালার দিকে সে তাকিয়ে আছে। জানালাটা বেশ বড় বড় কাঁচের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে অদ্ভুত একটা বর্ডার টানা হয়েছে। উল্লেখ করার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল না।
ডাকলাম, অ্যান! এবার আমাদের ফিরতে হবে।
একটু নিরবতা। তারপর অ্যান প্রথমে ধীর পায়ে, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। তাকে বিচলিত দেখাচ্ছে। সে এলে বললাম, এবার আমাদের যেতে হবে। এমনিতেই মি. ট্যাপলোর অনেক সময় নষ্ট করেছি।
মোটেই না, ট্যাপলো বলল। সে একদৃষ্টিতে অ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে।
অ্যান শুধাল, পাশের বাড়িটাতে কেউ থাকে কি? আমি জানি ওটা খালি, কিন্তু–
কিন্তু কী? ট্যাপলো বলল।
অ্যান হাসল। জানালায় কাকে যেন দেখলাম। কে যেন জানালায় দাঁড়িয়েছিল আর সেই মহিলা–
মহিলা? ট্যাপলো বলল। আপনি বলছেন মহিলা?
অ্যান তার দিকে তাকাল। না, অবশ্য এটা আমার কল্পনাও হতে পারে। বাড়িটা তো খালি। একতলার জানালাগুলো কাঠ মেরে আটকে দেয়া হয়েছে। তবু–
আমি বললাম, হয় তো কোনো ভবঘুরে হবে। অথবা কোনো অনধিকার প্রবেশকারী, ওরকম খালি বাড়িতে লোকজন ঢুকে পড়তেই পারে।
ট্যাপলো বলল, না। দরজাগুলো তক্তা দিয়ে এঁটে দেয়া হয়েছে। কেউ ঢুকতে পারবে না।
অ্যান বলল, তাহলে তো মিটেই গেল। হয়তো চোখে ভুল দেখেছি।
ঠিক তাই। বলে ট্যাপলো হঠাৎ মুখ ঘোরাল। আমরাও তাকে অনুসরণ করে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। হল থেকেই আমরা বিদায় নিলাম। বলে এলাম বাড়ির ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা এজেন্টকে জানিয়ে দেব। গাড়িতে ওঠার আগে অ্যান একটি কথাও বলল না।
তারপর বেশ জোর দিয়েই বলল, একটা কিছু আমি নিশ্চয় দেখেছি। জানালায় কেউ একজন ছিল।
আমি অস্বস্তি বোধ করলাম। বেশ তো, তুমি না হয় জানালায় কাউকে দেখেছ। তাতে কি হলো? বাড়িতে কেউ ছিল, ব্যস মিটে গেল।
অ্যান আবার বলল, একটি মেয়েকে দেখেছি। সে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
আমি তার দিকে ঘুরে তাকালাম। আচ্ছা, এটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছ কেন?
অ্যান ভুরু কুঁচকে বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু না, ও কিছু না। তুমি ঠিকই বলেছ। এটা মোটেই গুরুতর কিছু নয়।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তা কেন হবে? তুমি নিশ্চয়ই এটাকে গুরুতর মনে করছ। তা না হলে কথাটা বলতেই না।
বাদ দাও। এখন বাড়ি চলো।
আমি কঠিন গলায় বললাম, তুমি যতক্ষণ এ ব্যাপারে জানালার ওই মেয়েটির ব্যাপারে সব কথা না বলছ, ততক্ষণ আমি যাব না।
আমার কথা তুমি বিশ্বাস করবে না।
আগে তো বলো। তারপরে দেখা যাবে।
অ্যান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বেশ, তাহলে শোনো। মেয়েটি দেখতে একদম সাদামাটা। লাল চুল। কিন্তু মুখটা… অ্যান শিউরে উঠল। বেশ ঠান্ডা পড়েছে, তাই না?
তার হাতে হাত রাখলাম। মোটেই ঠান্ডা পড়েনি। কথা ঘুরিয়ো না। মুখের কথা কী বলছিলে?
মুখ-মুখটা বিবর্ণ, সন্ত্রস্ত। তার চোখ… সে যেন আমাকে কিছু বলতে চাইছিল। মনে হলো দেখ, আমি হলফ করে বলতে পারি, সে আমার কাছে সাহায্য চাইছিল। সাহায্যের জন্য মিনতি জানাচ্ছিল। কোনো কিছু থেকে তাকে উদ্ধার করতে বলছিল। অ্যান মাথা নাড়ল। হয়তো এসবই আমার কল্পনা। কিন্তু তাকে এমন মরিয়া লাগছিল…
কী বলব বুঝতে পারছি না। অ্যান সেরকম কল্পনাপ্রবণ মেয়ে নয়। আমার বিশ্বাস সে জানালায় কাউকে দেখেছে, কিন্তু বাকিটা….। ট্যাপলো বলেছে বাড়িটা খালি, আর দরজা ভেঙে কেউ বাড়িটাতে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু বাগানে তার আচরণও তো খানিকটা বেখাপ্পা ছিল।
হালকাভাবে বললাম, রোদে তোমার ভিরমি লেগেছে।
ঠাট্টাটা কাজে লাগল না। অ্যান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
জানতাম তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কাজেই এসব ভুলে যাওয়াই ভাল। ধরে নাও এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ঠিক আছে?
অ্যাজ ইওর উইশ। আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম।
অ্যান বলল, বেশ। এসব কথা আমরা ভুলেই যাব। এবার বাড়ি চল। আমার একটু ড্রিংক দরকার।
মদ্যপান আমারও প্রয়োজন। গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলাম। চললাম নিজ আবাসে।
বাড়ি ফিরে বাড়িটা নিয়ে অনেক কথা হলো। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, বাড়িটা কেনা হবে। যদিও বাড়িটা আমাদের কারোরই খুব পছন্দ নয়, তবু দাওটা হাতছাড়া করতে চাই না। দরকার হলে পরে আর একটা ভাল বাড়ি কিনে নেব।
নতুন বাড়িতে প্রথম কয়েকটা সপ্তাহ কোনো অঘটন ঘটল না। বাড়িতে নতুন করে কিছু করারও ছিল না। কেবল ঘরের যে রংয়ের পরিকল্পনা ট্যাপলো করেছিল সেটা আমাদের পছন্দ হয়নি; দুএকটা ঘর নতুন করে সাজানোও হলো। এটুকু ছাড়া আর কোনো অদল-বদলই হলো না।