বাড়িটা সত্যি সাধারণ। ২৬ নম্বর ব্রায়ারফিল্ড অ্যাভেনিউ-এর বাড়িটা শহরতলীর অন্য সব বাড়ির মতোই; সামনে টিউডর আমলের নকল পাশকপালি লাগানো আর ঢালাই– লোহার একটি বিশ্রি ফটক। কোনো গ্যারেজও নেই। অবশ্য এটুকু ছাড়া বাড়িটার আর তেমন দোষ চোখে পড়ল না।
অ্যান বলল, পাশের বাড়িটা কিন্তু অনেক বেশি সুন্দর। ঠিক আমার মনের মতো।
বিচলিত বোধ করলাম। ২৬ নম্বর বাড়ির অন্য অংশটাই ২৪ নম্বর। দুটো বাড়ি মোটামুটি একই রকমের।
অ্যান বলল, না, না, ওটা নয়। ওই পাশের বাড়িটা।
ও পাশের বাড়িটা এখানকার সাদামাটা পরিবেশের তুলনায় সত্যি অনেক আকর্ষণীয়। ভিক্টোরীয় ছাদের গঠন, লম্বা জানালা, গম্বুজ। বাগানের গাছগুলো অযত্নে বেড়ে উঠেছে। দেখলেই বোঝা যায় বাড়িটা অনেক দিন খালি পড়ে আছে।
হ্যাঁ, খুব সুন্দর। তবে বড় বড়। মেরামত করতে অনেক টাকা ঢালতে হবে।
অ্যান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। ও গাড়ি থেকে নামল। বেশ তো, ২৬ নম্বর বাড়িটাই দেখা যাক।
যে লোকটি ফটক খুলে দিল সে আমার বয়সী; ফ্যাকাসে চেহারা, চোখে চশমা, গায়ে সবুজ কার্ডিগান। মনে হলো আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা সে দেখতেই পায়নি, অথবা দেখতে চায়নি। বলল, আমার নাম ট্যাপলো। আর আপনি নিশ্চয়ই–
ডেভিড টার্নার। ইনি আমার স্ত্রী।
ঠিক আছে। ভেতরে আসুন।
হলে ঢুকলাম। অ্যান আবহাওয়া সম্পর্কে কি যেন বলল, কিন্তু ট্যাপলো তার দিকে ফিরেও তাকাল না। হঠাৎ বলে বসল, বাড়িটা ভাল। মনে হয় আপনাদের পছন্দ হবে। এটা বৈঠকখানা।
একজোড়া মেষের মতো ট্যাপলোর সঙ্গে বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। ভেতরটা বাইরের মতো নিতান্ত সাধারণ। খুব সম্প্রতি কিছুটা সাজানো হয়েছে। ট্যাপলোই বলল ওয়্যারিংটা নতুন। আসবাবপত্র এবং কার্পেট নতুন বলেই মনে হলো। অ্যানের মুখ দেখেই বলে দেয়া যায় বাড়িটা দেখে সে মোটেই খুশি হয়নি, কিন্তু আমার কাছে বেশ ভালই লাগল, আর বেশ সস্তাও বটে। দামটা যদি ঠিক-ঠাক বলা হয়ে থাকে, এবং বাড়িটার যদি গোপন কোনো ত্রুটি না থাকে, তাহলে কথাটা পাকা করে ফেলাই ভাল। দরকার হলে পরে আমরা এটা বিক্রি করে দিয়ে একটা আধুনিক প্যার্টানের বাড়ি কিনতে পারব।
রান্নাঘরে পৌঁছে আমাদের যাত্রা শেষ হলো। ট্যাপলো আমার দিকে ফিরে বলল, দামটাও ন্যায্য বলেই আমার ধারণা। আপনাকে খোলাখুলিই বলছি, বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা আমি তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলতে চাই। আমার চোখে মুখে নিশ্চয়ই একটা সন্দেহ ঝিলিক দিয়েছিল, কারণ সে তখনই বলে উঠল, বাড়িটার যে কোনো সমস্যা আছে তা কিন্তু নয়। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমরা- আমি মাত্র ছমাস এ বাড়িতে বাস করেছি, আর বাড়িটা তৈরি করাও হয়েছে বেশ মজবুত ভাবে। প্রতিবেশীরাও ভদ্র। রাস্তাটাও ভাল। এটা একটা আদর্শ বাড়ি।
বুঝলাম অ্যানের আগ্রহ বেড়েছে। বাড়িটা তাকে খুশি না করুক, ট্যাপলো করেছে। তার স্বভাবই ওইরকম কোনো বস্তুর চাইতে মানুষের প্রতি টান বেশি।
ট্যাপলো তার সহানুভূতিটা ধরতে পারল। একটু কেশে বলল, কয়েক সপ্তাহ আগে আমার স্ত্রী মারা গেছেন। স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক… কাজেই বুঝতে পারছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই। একটু থেমে যোগ করল, ঠিক আছে। তাহলে ওই কথাই রইল । ভাল কথা, ওই দামের মধ্যেই কার্পেটগুলো পাচ্ছেন। আর রাতে ব্যবহারের জন্য। হিটারগুলোও।
আমি পরিষ্কার বলে দিতে পারি, ট্যাপলোর স্ত্রীর কথা জানবার জন্য অ্যানের মন তখন উশখুশ করছে। সংকোচের সঙ্গেই সে প্রশ্ন করল, অনেক–অনেকদিনের অসুখ বুঝি?
কী বললেন? না, না, মোটেই তা নয়। খুবই আকস্মিক–অপ্রত্যাশিত। এই প্রথম তার মুখে হাসি দেখলাম। জোর করা হাসি, তবু হাসি তো বটে। তিনি এ বাড়িতেও মারা যাননি, আপনারা সে ভয় করবেন না। বাড়িটা ভুতুড়েও নয়। সে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল, এটা ভুতুড়ে বাড়ি নয়।
এবার অ্যানের বিচলিত হবার পালা। কোনোরকমে একটু হেসে সে জানালার কাছে গেল। বলল, আরে, দেখ, বাগানটা দেখ। বাগানের কথা তো আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।
ট্যাপলো বলল, ভুলটা আমারই। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। পিছনের দরজাটা খোলা হলো। তার পিছন পিছন আমরাও বাইরে গেলাম।
বাগানটা লম্বা ও সরু; এবং বাড়িটার মতোই সাধারণ। লনটার দিকে এখনই নজর দেওয়া দরকার; একেবারে শেষ প্রান্তের সজি বাগানটার অবস্থাও তথৈবচ। অ্যানের খুব বাগানের শখ। তাই আমি ট্যাপলোকে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম, আর সে বাগানে ঘুরে বেড়াতে লাগল। একটা ওষধি গাছের সারি সে খুব ভাল করে দেখছে।
ট্যাপলো বলল, এখানে একটা ভাল বাগান করার পরিকল্পনা আমাদের ছিল, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।
করলে ভালই হতো, কথার পিঠে কথা বললাম।
খোলা হাওয়ায় খাবারের স্বাদই বেড়ে যায়, মন্তব্য করল ট্যাপলো।
আমাদের কথা এর বেশি এগোল না। অ্যানের দিকে তাকালাম। সে বাগানের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের গম্বুজওয়ালা ভিক্টোরীয় বাড়িটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ। তার দীর্ঘ চুলের রাশি সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে।
বললাম, ওই বাড়িটা আমার স্ত্রীর বেশ পছন্দ হয়েছে। ওটা তো খালি, তাই না?
ট্যাপলো জবাব দিল না। সে তাকিয়ে আছে অ্যানের দিকে। তার মুখে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি।