মিসেস হোয়াইট হাসলেন। ছেলেকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তারপর ব্রেকফাস্টের টেবিলে ফিরে এলেন। স্বামীর বিশ্বাসপ্রবণতা নিয়ে হাসিঠাট্টায় নিজেকে খুব হালকা লাগছিল তাঁর। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ল ডাকপিয়ন। তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ডাকপিয়ন দর্জির দোকানের বিল দিয়ে গেল।
.
সেদিন ডিনারে বসে মিসেস হোয়াইট বললেন, তোমার ছেলে যখন ফিরবে তখন দেখবে সে আরও কত মজার মজার কথা বলবে। ভারি দুষ্টু।
বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে মি. হোয়াইট বললেন, তা হয়তো বলবে। তবে কসম খেয়ে বলছি ওটা আমার হাতের মধ্যে নড়াচড়া করছিল।
তোমার মনে হয়েছিল ওটা নড়ছে, নরম গলায় বললেন মিসেস হোয়াইট।
আমি বলছি ওটা নড়ছিল। ভাবাভাবির ব্যাপার নয়। এটা ঠিক
মাঝপথে কথা থামিয়ে দিলেন তিনি। তারপর বললেন, কী হলো? অমন করে কী দেখছ?
মিসেস হোয়াইট উত্তর দিলেন না। তিনি বাইরে একটি লোকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। খুব রহস্যজনকভাবে ভদ্রলোক ঘোরাফেরা করছিলেন। বাড়িটার দিকে তিনি এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন মনস্থির করতে পারছিলেন না কী করবেন।
আগন্তুকের পোশাক পরিচ্ছদ খুব চমৎকার। মাথায় পশমের টুপি, চকচকে, নতুন। বার তিনেক ভদ্রলোক গেটের সামনে থামলেন। তারপর আবার হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন। চতুর্থবার তিনি গেটের ওপর হাত রেখে দাঁড়ালেন। এবং হঠাৎ কী মনে করে গেট খুলে ফেললেন। এগিয়ে আসতে লাগলেন সামনের দিকে।
মিসেস হোয়াইটের হাত সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিছনে চলে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি অ্যাপ্রনের দড়ি খুলে ফেললেন। চেয়ারের গদির তলায় ঢুকিয়ে দিলেন সেটা। ভদ্রলোককে ঘরে নিয়ে এলেন। মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক খুব অস্বস্তিতে ভুগছেন। একবার তিনি আড়চোখে মিসেস হোয়াইটের দিকে তাকালেন। মিসেস হোয়াইট তাঁর অগোছালো ঘর এবং তাঁর স্বামীর কোটটির জন্য বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলেন। সাধারণত বাগানে কাজ করার সময় কোটটি মি. হোয়াইট পরে থাকেন। কিন্তু এ কথা যেন ভদ্রলোকের কানে যাচ্ছিল না। মিসেস হোয়াইট ভাবছিলেন, ভদ্রলোক হয়তো এবার তাঁর আসার কারণ জানাবেন। কিন্তু তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। ভদ্রলোক অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তারপর এক সময় টেনে টেনে বললেন, আমাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে। ভদ্রলোক একটু নিচু হলেন, তারপর তাঁর ট্রাউজার থেকে একটা আঁশ তুলতে তুলতে বললেন, আমি আসছি ম অ্যান্ড মেগিন্স থেকে।
মিসেস হোয়াইট চমকে উঠলেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে তিনি বললেন, কী ব্যাপার? হার্বার্টির কিছু হয়েছে? দয়া করে বলুন কী হয়েছে?
মি. হোয়াইট বললেন, শোনো, শোনো, চেয়ারে বোসো। আবোল তাবোল ভাবছ কেন?
তারপর আগন্তুকের দিকে তাকালেন, আপনি নিশ্চয় আমাদের জন্য কোনো খারাপ নিয়ে আসেননি।
আগন্তুক বললেন, আমি খুব দুঃখিত–
হার্বার্টির কী কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে? তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হোয়াইট।
আগন্তুক মাথা নাড়লেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, বড় একটা দুর্ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু এখন আর তার কোনো কষ্টই নেই।
যাক বাঁচা গেল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এর জন্য ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ–হঠাৎ মিসেস হোয়াইট থমকে গেলেন।
আগন্তুকের কথাটির মানে তিনি যেন হঠাৎ বুঝতে পারলেন। তিনি আবার তাকালেন ভদ্রলোকের মুখের দিকে। তাঁর বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে মিসেস হোয়াইট বুঝে গেলেন আসলে কী ঘটেছে।
তাঁর নিঃশাস যেন বন্ধ হয়ে গেল। স্বামীর দিকে ফিরলেন তিনি। কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখলেন স্বামীর হাতের উপর। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
অনেকক্ষণ পর আগন্তুক আস্তে আস্তে বললেন, তাকে যন্ত্র পিষে ফেলেছে।
মি. হোয়াইট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তার হাতের মধ্যে স্ত্রীর হাত। তিনি তাঁর স্ত্রীর হাতের ওপর অল্প অল্প চাপ দিচ্ছিলেন। ঠিক চল্লিশ বছর আগে তাদের পূর্বরাগের দিনগুলোর মতো।
এক সময় আগন্তুকের দিকে আস্তে আস্তে ফিরে তিনি বললেন, আমাদের ওই একটিই মাত্র ছেলে। ওর কী খবর নিয়ে এসেছেন আপনি।
আগন্তুক কাশলেন, উঠে দাঁড়ালেন তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন জানালার কাছে। বললেন, আপনাদের এই নিদারুণ ক্ষতিতে কোম্পানি আপনাদেরকে গভীর সহানুভূতি জানিয়েছে। আশা করি বুঝতে পারছেন আমি এদের একজন কর্মচারী মাত্র। আমি এসেছি শুধু ওদের নির্দেশ পালন করতে।
প্রত্যুত্তরে কেউ কিছু বললেন না। মিসেস হোয়াইটের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। দৃষ্টি স্থির। তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যাচ্ছিল না। আর মি. হোয়াইট ভাবছিলেন, সার্জেন্ট মেজরের কথাগুলো হয়তো এইভাবেই ফলতে শুরু করল।
ভদ্রলোক বলে বললেন, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ম. অ্যান্ড মেগিন্স সব দায়িত্ব অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো দায়িত্বই নেই। কিন্তু আপনাদের পুত্রের কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ তারা আপনাদের কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে চেয়েছেন।
মি. হোয়াইটের শিথিল হাত থেকে তাঁর স্ত্রীর হাত ছুটে গেল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চোখ মুখে আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আগন্তুকের দিকে। তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে। কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন, কত?
দুশো পাউন্ড।
মিসেস হোয়াইট চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু সে চিৎকার মি. হোয়াইটের কানে গেল না। তাঁর মুখে হাসির রেখা। তিনি অন্ধের মতো হাত দুটো বাড়িয়ে দিলেন সামনের দিকে। তারপর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।