কিন্তু দেখল পিশাচটা তার রেকাবে দাঁড়িয়ে পড়েছে, মাথাটা ছুঁড়ে মারল হেরনকে লক্ষ্য করে। হেরন ছুটে আসা মিসাইলটাকে ফাঁকি দিতে চাইল। কিন্তু পারল না। ভয়াবহ গতিতে ছুটে এল ওটা, দড়াম করে আছড়ে পড়ল হেরনের খুলিতে! ঘোড়ার পিঠ থেকে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল হেরন। বুলেট, কালো ঘোড়া আর পিশাচ বাতাসে ঘূর্ণি তুলে চলে গেল তার পাশ কাটিয়ে।
আট
পরদিন বুড়ো বুলেটকে দেখা গেল তার মনিবের বাড়ির ফটকের বাইরে ঘাস চিবোচ্ছে। পিঠে জিন নেই। নাস্তার টেবিলে দেখা গেল না হেরনকে। দুপুরের খাওয়ার সময়েও তার খবর নেই। বাচ্চারা স্কুলে এলো। কিন্তু অনুপস্থিত তাদের মাস্টার।
রাফায়েল হেরনের হলোটা কী? অবাক রডরিক রিপার। আর আমার ঘোড়ার জিনই বা কোথায়?
প্রতিবেশীকে নিয়ে হেরনকে খুঁজতে বেরুল রিপার। ময়লা আবর্জনার মধ্যে বুলেটের স্যাডলের দেখা মিলল। ঘোড়ার খুরের ছাপ লক্ষ করে ওরা গির্জার ধারের সেতুতে চলে এল। ঝর্ণা বা জলাধারাটির তীরে পেয়ে গেল হেরনের টুপি। ওটার পাশে ছিটিয়ে আছে কয়েক টুকরো কুমড়ো। জলধারার আশপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজল দুই কৃষক। সন্ধান মিলল না হেরনের।
হেরনের ঘর খুঁজে অল্প কিছু জিনিস পাওয়া গেল। কয়েকটি জামা, একটা জং ধরা রেজার, খান কয়েক বই। একটি বইয়ের পেছনের পাতায় হেরন কবিতা লিখেছে জুলিয়াকে নিয়ে। রডরিক রিপার কবিতাসহ অন্যান্য বইপত্রগুলো পুড়িয়ে ফেলল।
আমি আর জীবনেও আমার বাচ্চাদেরকে স্কুলে পাঠাব না, সিদ্ধান্ত নিল সে, লেখাপড়া শিখে কোনো লাভ নেই।
রোববারে গির্জায় সবাই রাফায়েল হেরনের রহস্যময়ভাবে গায়েব হয়ে যাবার ব্যাপারটি নিয়ে গল্পে মেতে উঠল। অনেকেই গেল সেতুর ধারে যেখানে টুপি আর কুমড়ো দেখে এসেছে রিপার। নানাজনে নানা গল্প ফাঁদল। তবে শেষে সবাই একমত হলো, হেরনকে মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ার ধরে নিয়ে গেছে।
.
এরপরে আর কেউ হেরনের অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে কথা বলার সাহস পেল । গ্রামবাসী অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেল স্কুল, নিয়োগ করল নতুন শিক্ষক।
অনেক বছর পরে, বুড়ো এক কৃষক এসে বলতে লাগল বেঁচে আছে। রাফায়েল হেরন। সে দেশের দূরের এক অঞ্চলে চলে গেছে, ওখানে আরেকটা স্কুলে মাস্টারি করছে। হেরন নাকি আইন পড়েছিল, পরে সে আইনজীবীর পেশা বেছে নেয়, পত্রিকায় লেখালেখিও করে এক সময়ে, এক পর্যায়ে বিচারপতির পদেও তাকে বসানো হয়েছিল।
রাফায়েল হেরন নিখোঁজ হবার কিছুদিন পরে রোমিও ফার্নান্দেজ বিয়ে করে সুন্দরী জুলিয়াকে। তার হাবভাবে মনে হচ্ছিল হেরনের অদৃশ্য হয়ে যাবার আসল কারণ সম্ভবত সে জানে। কেউ টুকরো হয়ে যাওয়া কুমড়োর কথা বললেই সে হাসিতে ফেটে পড়ত।
তবে বুড়ো চাষাদের স্ত্রীরা দাবি করত তারা নাকি জানে আসল ব্যাপারটা। তারা নিশ্চিত ছিল হেরনকে কোনো মন্দ আত্মা ধরে নিয়ে গেছে। শীতের রাতে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে, অগ্নিকুণ্ডের সামনে গোল হয়ে বসে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলত তারা।
পরিত্যক্ত স্কুল বাড়িতে–বলত তারা, হেরনের আত্মা নাকি ঘুরে বেড়ায়। গ্রীষ্মের রাতে ওই বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে শোনা যাবে করুণ সুরের প্রার্থনা সংগীত, গানটা প্রতিধ্বনি তুলে ভেঙে দেয় স্লিপিহলোর সুনসান নীরবতা।
–রাডিয়ার্ড কিপলিং
সাত
সত্যি তো, সেদিন ট্রেনে আমি কাকে দেখেছিলাম? এ প্রশ্নের উত্তর আমি আজ পর্যন্ত পাইনি। তাই প্রশ্নটার কোন সদুত্তর দিতে পারিনি। শুধু জানি সেদিন ট্রেনের কামরায় যিনি আমার সহযাত্রী ছিলেন তাঁর চেহারা অবিকল মি. ডুয়েরিং হাউসের মতো। অবশ্য নিহত মি. ডুয়েরিং হাউসের মৃতদেহটা তখন পড়েছিল একটা পরিত্যক্ত খড়ির খাদের মধ্যে–গাছের শুকনো ডালপালা আর পচা পাতার তলায়। পড়েছিল দশ সপ্তাহ ধরে। জায়গাটা ব্ল্যাকওয়াটার আর ম্যালিংফোর্ডের মাঝামাঝি। মি. ডুয়েরিং হাউস বেঁচে থাকতে যেভাবে কথাবার্তা বলতেন, যে ভঙ্গীতে চলাফেরা করতেন আমার সহযাত্রী ঠিক তেমনিই করেছিলেন। তাঁর চেহারারও অবিকল মি. ডুয়েরিং হাউসের মতো। সহযাত্রীর কাছ থেকে আমি যেসব কথাবার্তা শুনেছিলাম, তা অন্য কোনভাবে আমার জানার সম্ভাবনা নেই। মনে হয় হত্যাকারীকে যাতে আমি সনাক্ত করতে পারি সেজন্য মি. ডুয়েরিং হাউসের বিদেহী আত্মা আমাকে চালনা করে নামিয়েছিল জংশন স্টেশনের প্লাটফরমে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য, হত্যাকারী যাতে আইনের হাত থেকে নিষ্কৃতি না পায় সেজন্য বিদেহী আত্মা দেহ ধারণ করেছিল কিছু সময়ের জন্য, সেই স্টেশনে আমি দেখেছিলাম অতীতের ছায়া, গ্যাস পোস্টের নিচেই রাইকসের সঙ্গে মি. ডুয়েরিং হাউসের দেখা হয়েছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে তাঁরা কথা বলেছিলেন কিছুক্ষণ, অপঘাতে মৃত ব্যক্তির অতৃপ্ত আত্মা অতীতের সেই দৃশ্যটাই তুলে ধরেছিল আমার চোখের সামনে। যন্ত্ৰী আত্মা যন্ত্রের মতো ব্যবহার করেছে আমাকে। আমাকে দিয়েই সে লোকচক্ষুর সামনে প্রকৃত ব্যাপারটা তুলে ধরতে চেয়েছে এছাড়া আর কী ব্যাখ্যা আছে এই রহস্যময় ব্যাপারের?
সিগারকেসের রহস্যের সমাধান হলো। অনুসন্ধানে জানা গেল আমি যে কামরায় উঠেছিলাম, সে কামরাটি কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যবহার করা হয়নি। আর এই কামরাতেই হতভাগ্য মি. ডুয়েরিং হাউস তাঁর শেষ যাত্রায় বেরিয়েছিলেন। সিগারকেসটাকে তিনিই কামরায় ফেলে গিয়েছিলেন। আমি পাবার আগে কেউ-ই কেসটা লক্ষ করেনি। কামরাতেই পড়ে ছিল ওটা।