স্ত্রী মিসেস হোয়াইট সান্ত্বনা দেয়ার সুরে বললেন, মন খারাপ কোরো না। পরের গেমে তুমিও জিততে পারো।
মা ছেলের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। সেদিকে চোখ পড়ল মি. হোয়াইটের। তিনি চুপ করে গেলেন। অপরাধীর মতো মুখ করে হাসার চেষ্টা করলেন। তার পাতলা ধূসর দাড়ির মধ্যে সেই হাসি মিলিয়ে গেল ।
গেট খোলার শব্দ হলো জোরে। দরজার দিকে এগিয়ে আসছে ভারী পদধ্বনি। ওই যে তিনি এলেন। বলল হার্বার্ট হোয়াইট।
মি. হোয়াইট তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন, দরজা খুলে দিলেন এবং অতিথির আসতে কষ্ট হয়েছে বলে দুঃখপ্রকাশ করতে লাগলেন। মেহমানও স্বীকার করলেন তার একটু কষ্ট হয়েছে। মি. হোয়াইট লম্বা, মোটাসোটা ছোট ছোট চোখ এবং লাল মুখ একজন লোককে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকলেন। আস্তে করে কাশলেন মিসেস হোয়াইট।
মি. হোয়াইট বললেন, ইনিই সার্জেন্ট মেজর মরিস।
সার্জেন্ট মেজর করমর্দন পর্ব সেরে বসে পড়লেন আগুনের পাশে একটা চেয়ারে। হুইস্কি এবং গ্লাস বার করলেন মি. হোয়াইট। তামার কেটলিটা আগুনের ওপর। মরিসের দৃষ্টি এ সবের দিকেই।
তৃতীয় গ্লাস হাতে নিয়ে সার্জেন্ট মেজরের চোখ জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল। তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর চওড়া কাঁধ চেয়ারে ছড়ানো। তিনি বলে চলছিলেন অদ্ভুত সব দৃশ্যের কথা। তার দুঃসাহসী কাজের কথা, যুদ্ধ, প্লেগ এবং অদ্ভুত সব মানুষ নিয়েও তার গল্প চলল।
মি. হোয়াইট স্ত্রী আর পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, একুশ বছর হয়ে গেল। যখন মরিস চলে যায় তখনও সদ্য যুবক। আর আজ ওকে দেখ।
তারপর য়েগ করলেন, আমি নিজে একবার ভারতে যেতে চাই। নিজের চোখে সবকিছু দেখব আর কি।
সার্জেন্ট মেজর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশ তো আছেন এখানে। তিনি খালি গ্লাসটা মুখ থেকে নামালেন। হালকা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।
মি. হোয়াইট বললেন, আমি ওইসব পুরানো মন্দির, ফকির আর যাদুকরদের দেখতে চাই। আচ্ছা মরিস, আপনি সেদিন বানরের থাবা না কী যেন একটা জিনিসের কথা বলছিলেন না?
মরিস তাড়াতাড়ি বললেন, কিছু না। ওটা শোনার মতো কিছু নয়।
মিসেস হোয়াইট আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, বানরের থাবা?
সার্জেন্ট মেজর বললেন, আপনারা একে ভোজবাজি বলতে পারেন।
তিনজন শ্রোতা সাগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকলেন। মরিস অন্যমনস্কভাবে খালি গ্লাসটাই মুখে তুলে ধরে আবার সেটি টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। খালি গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে দিলেন মি. হোয়াইট।
সার্জেন্ট মেজর পকেট হাতড়াতে লাগলেন। বললেন, একটা ছোট্ট সাধারণ থাবা। শুকিয়ে মমি হয়ে গেছে।
তিনি পকেট থেকে জিনিসটি বার করলেন। রাখলেন সামনে। মিসেস হোয়াইট একটু পিছিয়ে গেলেন ভয়ে। কিন্তু ওঁর ছেলে হাতে নিল ওটা। দেখতে লাগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
ছেলের হাত থেকে থাবাটি নিলেন মি. হোয়াইট। ভালো করে দেখলেন, তারপর বললেন, এর বিশেষত্বটা কী? টেবিলের উপর রাখলেন থাবাটি।
একজন বুড়ো ফকির এই থাবাটিকে মন্ত্র পড়ে জাগিয়ে তোলেন। ছিলেন খুব ধার্মিক। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন ভাগ্যই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যারা একে আটকাতে চায়, তারা শুধু দুঃখকেই ডেকে আনে। তিনি থাবাটিকে মন্ত্রপূত করেছিলেন, থাবাটি তিনজন মানুষের তিনটি ইচ্ছাপূরণ করবে।
এইসব কথা শুনে ওদের মুখে হালকা হাসি ফুটল।
হার্বার্ট বলল, আচ্ছা, আপনি আপনার তিনটে ইচ্ছের কথা বলেননি?
প্রগলভ তরুণের দিকে যেভাবে মধ্যবয়স্করা তাকায়, ঠিক সেভাবেই মরিস তাকালেন হার্বার্টের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম। তাঁর ব্ৰণে ভরা মুখটি সাদা দেখাল।
মিসেস হোয়াইট জানতে চাইলেন, আপনার তিনটে ইচ্ছেই কি পূরণ হয়েছিল?
হয়েছিল, জবাব দিলেন সার্জেন্ট মেজর। শক্ত দাঁতে গ্লাসটি তিনি ঠক ঠক করে ঠুকলেন।
আর কেউ কি কিছু চেয়েছিল? বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন।
একজন তার তিনটে ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেছিল। সার্জেন্ট মেজর উত্তর দিলেন। প্রথম দুটি ইচ্ছে কী ছিল জানি না। তৃতীয়টিতে সে চেয়েছিল তার মৃত্যু। তারপর থাবাটি চলে আসে আমার হাতে।
মরিসের গলার গম্ভীর স্বরে পরিবেশ হয়ে উঠল থমথমে। সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। শেষে নীরবতা ভঙ্গ করে মি. হোয়াইট বললেন, মরিস, এটির তো আপনার আর দরকার নেই তাহলে আর এটিকে সঙ্গে রেখেছেন কেন?
মরিস মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বললেন, নিছক শখ বলতে পারেন। ভেবেছিলাম এটাকে বিক্রি করে দেব। কিন্তু বিক্রি হবে বলে মনে হয় না। অপকার যা করার তা ইতিমধ্যে থাবাটি করে ফেলেছে। তাছাড়া কেউ এটা কিনতেও চাইবে না। কারণ সবার ধারণা এটা একটা গল্পকথা। কেউ হয়তো অন্য কিছু ভাবে। কিন্তু তারাও চায় আগে পরখ করে দেখতে। তারপর টাকার কথা।
মি. হোয়াইট মরিসের দিকে তাকালেন। আপনি তো আপনার আরও তিনটে ইচ্ছের কথা বলতে পারেন? সেগুলো কি পূরণ হবে?
মরিস বললেন, আমি জানি না, সত্যি জানি না।
তিনি থাবাটি হাতে নিলেন। দু আঙুলে টিপে ধরে দোলাতে লাগলেন সেটিকে। তারপর হঠাৎ ছুঁড়ে দিলেন আগুনের ওপর। হোয়াইট ঝুঁকে পড়ে থাবাটি টেনে নিলেন।
এটা পুড়ে গেলেই ভালো, শান্ত আর গম্ভীর গলায় বললেন মরিস।
মরিস, আপনার তো আর থাবাটির দরকার নেই। তাহলে এটা আমার কাছেই থাক, মি. হোয়াইট বললেন।