বড় রাস্তার পাশে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে একটি সিগারেট ধরাল ওয়ালেস। এমন সময় কড়মড় করে জ্যান্ত হয়ে উঠল রেডিও।
পান্ডা সেভেন?
বলো, ক্লান্ত গলায় সাড়া দিল ওয়ালেস।
একবার ওক কটেজে যেতে পারবে? একজন ফোন করে বলল ওখানে নাকি কী একটা গোলমাল হয়েছে।
রজার।
দ্রুত ওক কটেজের উদ্দেশে গাড়ি ছোটাল ওয়ালেস। ভাবছে বৃদ্ধা মহিলা ঠিক আছেন কিনা। ছেলের দলকে সেদিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওখান থেকে সরিয়ে দেয়ার পরে সে বার কয়েক ও বাড়িতে গেছে। প্রতিবারই চা এবং কেক সহযোগে আপ্যায়িত হয়েছে ওয়ালেস। বৃদ্ধা জানিয়েছেন দুষ্টু ছেলের দল সেদিনের পরে তাঁকে আর বিরক্ত করেনি।
ওক কটেজের বাইরে গাড়ি থামাল ওয়ালেস। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল উৎকর্ণ হয়ে। নাহ্, অস্বাভাবিক কিছু শোনা গেল না। শুধু ওক মিডো বা বড় ওই মাঠটি থেকে বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে। তারা বোনায়ার আনজাম করছে।
কটেজের পথ ধরে হেঁটে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ল ওয়ালেস। হয়তো বৃদ্ধা এমন কিছু শুনেছেন যেজন্য পুলিশে ফোন করেছিলেন। ওয়ালেসকে দেখলে খুশিই হবেন তিনি। আর এ মুহূর্তে এক কাপ চা খেতে পেলে মন্দ হয় না।
কিন্তু দরজায় কড়া নাড়ার পরেও কোনো সাড়া মিলল না। ওয়ালেস বাড়ির পেছন দিকটাতে চলে এল। খিড়কির দুয়ার খোলা এবং পেছনের ঘরে আলো জ্বলছে।
জানালার আলোয় সে দেখতে পেল পেছনের বাগানের ঘাসগুলো সব দোমড়ানো মোচড়ানো। টর্চ জ্বেলে নিয়ে ট্রেইল ধরে এগোল ওয়ালেস। দেখে মনে হচ্ছে একদল বুনো জন্তু দাপিয়ে বেড়িয়েছে ঝোঁপের জঙ্গলে, সব লন্ডভন্ড করে ছেড়েছে। মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে আছে বেশ কিছু ঝোঁপঝাড়।
ট্রেইলের সমাপ্তি ঘটেছে একটি মস্ত ঝোঁপের ধারে। ঝোঁপ পার হতেই ওয়ালেস দেখে সে ওক মিডোতে হাজির হয়ে গেছে। দাউদাউ জ্বলছে বোনায়ার বা বহূৎসব। দূর থেকে কতগুলো কালো কালো ছায়ামূর্তি দেখা গেল আগুনটাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ছোটাছুটি করছে। কালো আকাশে হুউশ করে উড়ে গেল একটা হাওয়াই রকেট, আলোর ঝর্ণাধারা ছড়িয়ে দিল।
ওয়ালেস সামনে কদম বাড়াতে গিয়ে কীসে যেন হোঁচট খেল।
টর্চের আলোয় একটি মনুষ্য মূর্তি দেখতে পেল ওয়ালেস। যেনতেনভাবে তৈরি মূর্তি। মুখটা আঁকা হয়েছে কাঠকয়লা দিয়ে।
ওরা এটাকে পোড়াবে না?
অ্যাই, মিস্টার, ওর পাশ থেকে একটা বাচ্চা কণ্ঠ তীক্ষ্ণ সুরে বলে উঠল। ওয়ালেস তাকিয়ে দেখে এ ছেলেটিকে সে গোলাঘরে দেখেছিল। দারুণ, না?
হ্যাঁ, দারুণ বানিয়েছ, সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ওয়ালেস। তোমরা এই মূর্তিটাকে পোড়াবে না?
আমরা এর চেয়েও ভাল জিনিস পেয়ে গেছি। ওই দেখুন।
বিশাল অগ্নিকুণ্ডের দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল ওয়ালেস। দাউ দাউ অগ্নিশিখার মাঝে কোনো মতে একটা মানুষের কাঠামো বোঝা যায়। আগুনের ছোবল খেয়ে ওটা যেন নড়াচড়াও করছে।
এখন আর চিন্তার কিছু নেই, ওয়ালেসের পাশে দাঁড়ানো বাচ্চাটি ব্যগ্র কণ্ঠে বলল। আমরা এখন নিরাপদ। আমার ভাইয়ের বইতে পড়েছি কী করতে হবে– শুধু জোন অব আর্কের মতো…
জোন অব আর্ক?
ওই বিরাট কাঠের ঘোঁজে?
ওয়ালেস আগুনের কাছে এগিয়ে গেল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল অগ্নিশিখা মূর্তিটাকে নড়াচড়া করাচ্ছে কিন্তু এখন কাছে এসে দেখতে পাচ্ছে ওটা সত্যি নড়ছে, তীব্র আক্ষেপে মোচড় খাচ্ছে কিন্তু এ হতে পারে
— ও অসুস্থ বোধ করল, ঝিমঝিম করছে মাথা।
গভীর দম নিল ওয়ালেস ঝিমঝিমানি থেকে রক্ষা পেতে কিন্তু গা ভীষণ গুলিয়ে উঠল মাংস পোড়র গন্ধে।
অগ্নিশিখার ক্রমাগত পটপট আওয়াজ ছাপিয়ে কানে এল বাচ্চাগুলোর গানের ছন্দে বলা কথাগুলো।
আমরা ডাইনিটাকে পুড়িয়ে মেরেছি, আমরা ডাইনিটাকে পুড়িয়ে মেরেছি…
–সেন্ট জন বার্ড
ইচ্ছাপূরণ
রাতে ঠাণ্ডা ছিল না। ভিজে আবহাওয়াও নয়। তবু লেক্সনাম ভিলার ছোট্ট বৈঠকখানার পর্দাগুলো টানা ছিল। আগুনও জ্বলছিল বেশ উজ্জ্বলভাবে। দাবা খেলতে বসেছিলেন বাবা আর ছেলে। বাবা মি. হোয়াইট দাবা খেলার ব্যাপারে নানারকম মৌলিক পরিবর্তন আনার কথা প্রায়ই ভাবতেন। কিন্তু তিনি তাঁর রাজাটিকে এমন এক জায়গায় চাললেন যে তাঁর স্ত্রী মিসেস হোয়াইটও কথা না বলে থাকতে পারলেন না। সাদা চুলের বুড়িটি এতক্ষণ আগুনের পাশে একমনে সেলাই করে যাচ্ছিলেন।
খুব দেরি হয়ে গেলেও মি. হোয়াইট বুঝলেন তিনি মারাত্মক ভুল করে বসেছেন। তিনি বলে উঠলেন, কীসের একটা শব্দ হলো না? তিনি চাইছিলেন তাঁর ভুল যেন ছেলে দেখতে না পায়।
ছেলে হার্বার্ট মনোযোগ দিয়ে ছকটি দেখতে দেখতে বলল, হ্যাঁ, শুনেছি। তারপর হাতটা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, কিস্তি।
মি. হোয়াইট দাবার ছকের উপর হাতটা বাড়িয়ে রেখে বললেন, মনে হয় না তিনি আজ রাতে আসবেন।
হার্বার্ট শুধু উত্তরে বলল, কিস্তিমাত।
মি. হোয়াইট হঠাৎ যেন রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, এত দূরে থাকার কোনো মানে হয়! জঘন্য পাঁকে ভরা, পোডড়া জায়গা অনেক দেখেছি বাবা, কিন্তু এমনটি আর দেখিনি। ফুটপাতগুলো খানায় খন্দে ভরা রাস্তায় যেন জলের স্রোত বইছে। জানি না লোকেরা কী ভাবে। মনে হয় তাদের কিছু এসে যায় না। কেন না রাস্তায় মাত্র দুটো বাড়িই তো থাকার মতো।