না বেরুনোই ভালো। আমাকে লাইন থেকে বের করে বলল, আজ রাতে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড ঘটবে।
অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। কথা বলার সময় কেঁপে গেল গলা। কে লাগাবে আগুন–তুমি?
লারার মুখটা হঠাৎ বাঁকা হয়ে গেল, যেন ভেতরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।
ওরা আমাকে শুধু বলেছে আগুন লাগবে, হিসিয়ে উঠল ও। কে লাগাবে জানি না। চট করে রাগ উঠে গেল মাথায়। ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলাম। কী বলছ, লারা? ওর ঠাণ্ডা ঝকঝকে চোখে চোখ রাখলাম আমি। এসব ভয়ঙ্কর কথা কে বলে তোমাকে?
লারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে, আঁকি মেরে মুক্ত করল নিজেকে। তারপর দৌড় দিল রাস্তার দিকে। ফিরেও চাইল না। বাড়ি ফেরার পথে সারাক্ষণ ভাবলাম কী করা উচিত আমার। বাবা-মাকে বলে দেব নাকি স্কুলের প্রিন্সিপাল। স্যারকে জানাব? কিন্তু কেউ যদি বিশ্বাস না করে আমার কথা?
সে রাতে এগারোটা পর্যন্ত থাকলাম টেবিলে। আমার ভাই সিনেমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। যাইনি। সোশাল স্টাডিজের ওপর একটা নোট লিখলাম। নিচ তলায়, ড্রইং রুম থেকে টিভির আওয়াজ ভেসে আসছে। হঠাৎ চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলাম। ব্যাপার কী জানার জন্য এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নিচে। টিভিতে খবর হচ্ছে। যা দেখলাম তাতে হিম হয়ে গেল বুক।
ভাই যে সিনেমা হলে মুভি দেখাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আমাকে সেই প্রেক্ষাগৃহেই আগুন ধরে গেছে। টিভির এগারোটার খবরে সেই ঘটনাই বিস্তৃত দেখাচ্ছে।
খবর দেখে অসুস্থ, বমি বমি ভাবটা আবার ফিরে এল। আরেকবার ঘটনাটা ঘটেছে। যে করেই হোক লারা আগে জানতে পেরেছে অগ্নিকাণ্ডের কথা। ও বলেছিল আজ রাতে কোথাও আগুন লাগবে।
তক্ষুনি ফোন করলাম লারার বাড়িতে। ওর মা বললেন হঠাৎ করে লারার জ্বর এসেছে। জ্বরে কী সব আবোল তাবোল বকছে। আমি লারার মাকে দুএকটা সান্ত্বনা বাক্য শুনিয়ে রেখে দিলাম ফোন।
পরদিন স্কুলে এল না লারা। স্কুলের সবাই উত্তেজিত হয়ে সিনেমা হল এর অগ্নিকাণ্ডের কথা বলছিল। আমাদের স্কুলের একটি ছেলে জনতার হুড়োহুড়িতে আহত হয়েছে। তবে সিনেমা হল-এর খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। হল কর্মচারীরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে নিভিয়ে ফেলেছে আগুন। তবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা সম্ভব হয়নি।
ক্লাসটা আমার কাটল অদ্ভুত ঘঘারের মাঝে। খুব ইচ্ছে করছিল লারার গোপন কথাটা বলে দিই কাউকে। কিন্তু আদৌ কি কেউ বিশ্বাস করবে এ কথা? শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম মাকে জানাব।
বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই উদ্বিগ্ন মুখে মা বলল, লারার মা ফোন করেছিলেন। লারার অবস্থা খুবই খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে গেছে। লারা নাকি বারবার তোর কথা বলছিল।
কথাটা শুনে ছ্যাৎ করে উঠল বুক। লারার জন্য যা খুশি করতে পারতাম আমি। কিন্তু এখন ভয় করছে ওর কথা শুনে।
লারাদের সাথে আমাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক আছে। তাই মা-ই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে। রাস্তায় কোনো কথা বললাম না দুজনে। সারাক্ষণ ভাবছিলাম লারা কি ওর গোপন কথাগুলো বলার জন্যই আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে? এরপর কী করব আমি?
লারার কেবিনে ঢুকলাম। টের পেলাম বুকের ভেতর দমাদম পিটছে হৃৎপিন্ড। লারার চেহারা থেকে রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ। তবে চোখ জোড়া জ্বলছে। আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করলাম মণির ভেতরে লাল টকটকে দুটি বিন্দু রুবির মতো জ্বলজ্বল করছে।
আমাকে দেখে ফ্যাকাসে হাসল লারা। আমার মা ওর দিকে এগিয়ে গেল। কেমন আছ, মা, বলতে বলতে। লারা দুর্বল গলায় বলল, ডেভের সাথে একটু কথা বলব, আন্টি। আপনার যদি…।
লারার মা মেয়ের শিয়রে বসেছিলেন। কাঁদছিলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলুন, মিসেস উইনস্টন। আমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। লারাটা তখন থেকে ডেভ, ডেভ করছে।
মা কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। আমি লারার মাথার কাছে বসলাম। লারা আমার মাথাটা ধরল দুহাত দিয়ে, টেনে নিল ওর মুখের ওপর।
ওরা বলেছে আমি আর বাঁচব না, ফিসফিস করল লারা।
ডাক্তাররা বলেছেন? ভীরু গলায় জানতে চাইলাম আমি, ওর চোখের দিকে চাইতে ভয় লাগছে।
না, কণ্ঠগুলো, বলল লারা। কণ্ঠগুলো বলেছে আমি মারা যাব… খুব শীঘি।
ভেতরে ভেতরে কাঁপুনি উঠে গেছে আমার, ইচ্ছে করল এক ছুটে পালিয়ে যাই। কিন্তু লারা আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ওকে এভাবে রেখে যাই কী করে? ওকে আমার সাহায্য করা দরকার।
কোনো কণ্ঠ তুমি শুনতে পাওনি, লারা, ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। আর চিন্তা করিও না। শীঘ্রি ভালো হয়ে উঠবে তুমি।
সিধে হয়ে বসলাম আমি। লারার স্নান চেহারায় যন্ত্রণাকাতর হাসির সাথে ফুটে আছে ভয়ার্ত একটা ভাব।
আমি পাগল নই, ফিসফিস করল লারা। ওরা সারাক্ষণ আমার সাথে কথা বলে। কণ্ঠগুলো কথা বলে।
হঠাৎ আমার ঘাড় চেপে ধরল লারা, ওর মাথার কাছে নিয়ে এল মাথা। হিসিয়ে উঠল, শোন!
চিৎকার করে উঠলাম আমি। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। ওর দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, দেখি তৃপ্তির হাসি হেসে চোখ বুজল লারা। কণ্ঠগুলো আমাকে বলেছে আমি এখানে যেন বসে থাকি, বিদায় জানাই লারাকে। কারণ ওর সাথে আমার আর দেখা হবে না। আমার ইচ্ছে করল দৌড়ে পালাই। তাহলে সব কিছুর হাত থেকে রক্ষা পাব। কিন্তু কেউ যেন মেঝের সাথে আমার পা পেরেক দিয়ে গেঁথে রেখেছে। নড়তে পারলাম না এক চুল।