তাসের ভেল্কী আর নানান পাপাচারে পোক্ত হতে হতেই কেটে গেল দুটো বছর। তারপর ইউনিভার্সিটিতে এল সম্ভ্রান্ত এক যুবাপুরুষ। তার নাম লর্ড গ্লেনডিনিঙ। দেদার টাকার মালিক গুনে গেঁথেও নাকি শেষ করা যায় না। এই খবর কানে আসতেই চনমনে হয়ে উঠল আমার লোভী সত্ত্বা। নতুন কুবেরকে কায়দায় আনবার ফন্দিফিকিরে ব্যস্ত হলো মগজ। বার কয়েক টেনে আনলাম তাকে আমার তাসের জুয়োয়।
জুয়ারী কৌশল বিস্তার করে প্রতিবারেই কিছু টাকা জিতিয়েও দিলাম । জুয়া-শিল্পে চৌকস শিল্পীরা এইভাবেই শিকারকে ফাঁদে ফেলে। তারপর যখন দেখলাম জুয়োর নেশা বেশ জমেছে এবং তাস খেলে টাকা উপায় করার শিল্পে নিজেকে বড় শিল্পী বলে মনে করছে গ্লেনডিনিঙ, তখন একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করলাম আমারই এক বন্ধু মিস্টার প্রেসটন-এর বাড়িতে। সেখানে যে শেষকালে তাসখেলা হবে, তা ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দিলাম না। এমনকি মিস্টার প্রেসটন আমার হরিহর আত্মা বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যাপারটি সম্বন্ধে তাঁকে অন্ধকারেই রেখে দিলাম।
সবাই জানল, পার্টিতে শুধু খাওয়া-দাওয়া হবে, একটু-আধটু হৈ-হল্লা ফুর্তি হবে তার বেশি কিছু না সাত-আট জন কলেজ-বন্ধুকে নেমন্তন্ন করলাম বটে কিন্তু তাদেরও কেউ জানল না আমার মূল অভিপ্রায়।
শুধু আমিই জানতাম আমার ক্রুর অভিসন্ধির আগাগোড়া। টাকার কুমীর গ্লেনডিনিঙকে ভেঙে চুরমার করে দেব এই খেলায়।
খানাপিনা শেষ হওয়ার পর আকণ্ঠ মদিরা-সেবন করলাম প্রত্যেকেই । মাথার মধ্যে রিমঝিম রিমঝিম বাদ্যি শুরু হয়ে যেতেই তাসের নেশা মাথাচাড়া দিল গ্লেনডিনিঙ-এর মগজে। আলগা কথার মধ্য দিয়ে জুয়োর প্রসঙ্গটা আমিই এনে ছিলাম মদের আড্ডায়। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ল টাকার কুমীর। শুরু হয়ে গেল সর্বনাশা খেলা।
শুরু হয়েছিল সবাইকে নিয়েই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ছলচাতুরির জাল বিছিয়ে আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করালাম শুধ গ্লেনডিনিঙ-কেই। দেখলাম, ওর সারা মুখ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মদের নেশা আর খেলার উত্তেজনায়। পর-পর কয়েক দান খেলে গেলাম ঠান্ডা মাথায়। প্রতিবারেই বাজি হারল গ্লেনডিনিঙ এবং গনগনে হয়ে উঠল গোটা মুখ। জেতার নেশায় ও তখন আত্মহারা।
ওষুধ ধরেছে বুঝলাম এবং আর খেলতে চাইলাম না। সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল ধনকুবের প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি বেঁকে বসলাম খেলব না কিছুতেই। হেরে যাওয়ার এই ঝোঁক কাটিয়ে ওঠা উচিত গ্লেনডিনিঙের।
ও কিন্তু তার স্বরে বাজি ধরল দ্বিগুণ। আর সবাই অবাক হলেও আমি হলাম না। আমি তো জানি, এ-রোগের এই পরিণতিই হয়। যতই নিঃস্ব হতে চলেছে, ততই রাগ চেপে যাচ্ছে গ্লেনডিনিঙের। যেন নিমরাজী হয়ে তাস ভাগ করলাম। খেলা শুরু করলাম। শেষও করলাম। গো-হারান হেরে গেল গ্লেনডিনিঙ। এবং সেই প্রথম অবাক হলাম ওর মুখের রক্তরাঙা ভাবটা লক্ষ্য করে। একী নিছক মদের রক্তোচ্ছ্বাস, না, ফতুর হওয়ার পূর্বাভাস? আবার তাস সরিয়ে নিলাম কিন্তু গোঁ ধরে বসল ধনকুবের-নন্দন। খেলতেই হবে। এবার আরও দ্বিগুণ বাজি। ঘরশুদ্ধ সবাই হতভম্ব। আমি নিজেও একটু হকচকিয়ে গেলাম গ্লেনডিনিঙের মুখের অকস্মাৎ পান্ডুরাভা লক্ষ্য করে। ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে মুখখানা। ও যে প্রচন্ড বড়লোক, এ খবর নিয়েই তো জালে জড়িয়েছি এত অল্পে ভেঙে পড়বে, তা জানতাম না। এ-খেলাও শেষ হলো আমার হাতের কারসাজি মতোই। সমস্ত রক্ত নেমে গেল গ্লেনডিনিঙের মুখ থেকে।
ঘর নিস্তব্দ। প্রত্যেকেই নিশ্চুপ। ভর্ৎসনা মিশোনো জোড়া জোড়া চোখ নিবদ্ধ আমার ওপর। অসহ্য উদ্বেগ চেপে বসেছে আমার বুকের মধ্যে। দুঃসহ এই বোঝা ক্ষণিকের জন্যে লঘু হয়ে গেল আচম্বিতে ঘরের ভাবি দরজার পাল্লা দুটো দু-হাট হয়ে খুলে যাওয়ায়।
দমকা হাওয়ায় একই সঙ্গে নিভে গেল ঘরের সব কটা মোমবাতি। নিভবার মুখেই দেখতে পেলাম খোলা দরজা দিয়ে মূর্তিমান প্রহেলিকার মতোই ঝড়ের বেগে ঘরে আবির্ভূত হয়েছে এক লোক। মাথায় সে আমার সমান। আমার আলখাল্লার মতনই একটা আলখাল্লা দিয়ে ঘিরে রয়েছে অবয়ব। মোমবাতিগুলো ততক্ষণে নিভে গেছে। সলতেগুলোয় মরা আগুন লেগে রয়েছে। সেই আলোতেই নিবিড় তিমির ঘরের মধ্যে চেপে বসতে পারছে না। তাই ঠাহর করেছিলাম আমাদের ঠিক মধ্যিখানে এসে খাড়া হয়ে রয়েছে অন্ধকারের আগন্তুক। নিতান্ত অসভ্যের মতো এহেন অনধিকার প্রবেশের জবাবদিহি চাইবার আগেই শুনতে পেলাম তার কণ্ঠস্বর।
এ-সেই কণ্ঠস্বর যার ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি একবার শুনলে আর ভোলা যায় না। এ-সেই নিচু খাদের অতি-সুস্পষ্ট চাপা ফিসফিসানি যার প্রতিটি অনুরণন কাঁপালিকের মন্ত্রোচ্চারণের অমোঘ প্রতিক্রিয়ার মতনই হাড় হিম করে দিল আমার। কেটে কেটে অন্তরের গহনতম অন্দরেও বসে গেল এই কটি কথা!
জেন্টলমেন, অসৌজন্যের জন্যে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু এই অভব্য আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি শুধু একটা কর্তব্য পালনের জন্যে। আপনারা জানেন না, কেউই জানেন না –আজ রাতের খেলার নায়কের সত্যিকারের চরিত্রটা কি। অত্যন্ত বিনীতভাবে শুধু এই তথ্যটি পরিবেশন করার জন্যেই আমার আগমন। অনুগ্রহ করে এবং অবসরমতো আপনারা উইলিয়াম উইলসনের বা আস্তিনের ভেতরকার আস্তর পরীক্ষা করে দেখবেন। এমব্রয়ডারী করা আলোয়ানের মধ্যে লুকানো পকেটগুলো দেখতেও ভুলবেন না। চললাম।