তিন-তিনটে বছর যেন ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে গেল আমার জীবনের খাতা থেকে। উচ্ছঙ্খলতা কাকে বলে, তা দেখিয়ে দিয়েছি এই তিনটে বছরে। ডুবে থেকেছি পাপ কাজের পাকে। তাতে লাভ কিছুই হয়নি– ক্ষতি ছাড়া শরীরেও ভাঙন ধরেছিল একটু একটু করে।
শেষের দিকে একটা গোপন আড্ডায় জমায়েত করলাম আমার খারাপ কাজের সঙ্গীদের। আচ্ছা বসল আমারই ঘরে গভীর রাতে। তাসের। জুয়োয় মেতে উঠলাম, মদের নেশায় চুর চুর হলাম। শিরায় উপশিরায় রক্তের মধ্যে যখন তুফান জেগেছে, উন্মাদের অট্টহাসি হেসে ঘরের চার দেওয়ালে প্রায় চৌচির করে দিয়ে আরও মদ, আরও মদ করে চেঁচাচ্ছি ঠিক সেই সময়ে ভয়ানক শব্দে খুলে গেল ঘরের দরজা এবং চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে হেঁকে বলল একজন ভৃত্য –এক্ষুনি আমাকে আসতে হবে নিচের হলঘরে দেখা করার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক–তার আর তর সইছে না।
আচমকা বাধা পাওয়ায় মোটেই অবাক হইনি–বরং মজা পেয়েছিলাম। মদিরার প্রলয়-নাচান যখন মগজের প্রতিটি কোষকে বেদম বেহেড করে তুলেছে, ঠিক সেই সময়ে কে এই উটকো উৎপাত, তা দেখবার জন্যে তক্ষুনি ছুটে বেরিয়ে গেছিলাম ঘর থেকে।
টিমটিম করে একটা মাত্র বাতি জ্বলছিল বাইরের গলিপথে। সে আলোয় একহাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। তবে ঘুলঘুলি দিয়ে আসছিল ভোরের আলো। সেই দেখেই বুঝলাম, মদ খেয়ে আর তাস খেলে রাত ভোর করে দিয়েছি।
নিভুনিভু আলোয় হলঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম একজন যুবককে। উচ্চতায় সে আমার মতনই। পরনে যে হালফ্যাশনের সাদা রঙের ফ্রক কোট রয়েছে, সেটাও হুবহু আমার গায়ের ফ্রক-কোটের মতনই। আধো অন্ধকারে শুধু এইটুকুই দেখেছিলাম। তার মুখ দেখতে পাইনি। কেননা, আলো পড়ছিল না মুখে।
আমাকে দেখেই সে এস্তে ছুটে এল আমার দিকে। অধীর ভাবে খামচে ধরল আমার বাহু। কানের কাছে মুখটা এনে বলল চাপা, ভাঙা গলায় –উইলিয়াম উইলসন।
পলকের মধ্যে নেশা ছুটে গেল আমার।
আগন্তুক সেই মুহূর্তে তার তর্জনী তুলে ধরেছে আমার চোখের সামনে। ব্রেনের মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে তার চাপা শাসানি। কিন্তু এ যে সেই গলা, সেই সুর, সেই উচ্চারণ। কেটে কেটে প্রতিটি অক্ষরের ওপর জোর দিয়ে কথা বলার এই ঢঙ তো ভোলবার নয়। চোখের সামনে আঙুল নেড়ে বাহু খামচে ধরে আমার ঘোর কাটিয়ে দেওয়ার এই পন্থা তো আগেও ঘটেছে। আজ থেকে তিন বছর আগে!
অনেক উদ্দামতার তলায় চাপা পড়া অতি-ক্ষীণ স্মৃতিগুলো অকস্মাৎ আশ্চর্য রোশনাই ছড়িয়ে ভেসে উঠল আমার মনে। চকিতের জন্যে সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিলাম। নিঃসাড় হয়ে গেছিল আমার সব কটা ইন্দ্রিয়। পরক্ষণেই ধাতস্থ হলাম বটে কিন্তু তাকে আর দেখতে পেলাম না। বাতাসের বেগে উধাও হয়ে গেছে আমার হুঁশ ফেরার আগেই।
ঘটনাটা প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেল আমাকে। মদে আচ্ছন্ন ছিলাম ঠিকই, পাগলা ঘোড়ার মতোই আমার কল্পনাশক্তি দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে, তবে যা দেখেছি আর যা শুনেছি তা ভুল নয়। চোখ বা কানের বিভ্রম নয়।
কে এই উইলিয়াম উইলসন? আমি যেদিন ডক্টর ব্রান্সবির স্কুল ছেড়ে চম্পট দিইতার পরের দিনই উইলসনও স্কুল ছেড়ে বাড়ি চলে গেছিল ফ্যামিলিতে একটা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে। এইটুকু খবরই শুধু রাখতাম। তারপর সে কোন চুলোয় আছে, কী করে বেড়াচ্ছে– কিসসু খবর পাইনি। রাখবার চেষ্টাও করিনি। কিন্তু সেদিন রাতভোরে আমি যখন নরক-গুলজার করে চলেছি– ঠিক সেই সময়ে ধূমকেতুর মতো এসে অতীত দিনগুলোর মতো আমার সুবুদ্ধি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেই চকিতে আবার উধাও হয়ে গেল কেন?
চকিত-ধাক্কা হলেও, নড়ে গেছিল আমার মনের ভিত পর্যন্ত। ইটনের শিক্ষায়তন ছেড়ে দিলাম এর পরেই গেলাম অক্সফোর্ডে। আমার কোনো
অভিলাষেই অন্তরায় হননি আমার দুর্বলচিত্ত বাবা আর মা। সেবারেও হতে পারলেন না। উল্টো থাকা-খাওয়ার মাসিক ব্যবস্থা করে দিলেন। গ্রেট ব্রিটেনের আমীর-ওমরাদের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাওয়ার পথ এই ভাবেই তৈরি করে দিলেন আমার জনক এবং জননী।
চুটিয়ে কাজে লাগালাম সব কটা সুযোগ-সুবিধেকে। গ্রেট ব্রিটেনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বেলেল্লাপনা হয়নি- যা আমি করে গেছি অক্সফোর্ডে। নষ্টামির নানান ফন্দি রোজই গড়িয়ে উঠত আমার কু-মগজে এবং তার প্রতিটিতে ইন্ধন জুগিয়ে গেছে আমার নারকীয় সহচরেরা।
টাকা-পয়সা উড়িয়েছি খোলামকুচির মতো একটার পর একটা পাপ কাজ করে গেছি মনের আশ মিটিয়ে। সে সবের ফিরিস্তি দিয়ে পাঠকের পরিচ্ছন্ন রুচিবোধকে আঘাত দিতে চাই না।
শুধু এইটুকু বলব যে, এই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতেই পঙ্কিল জীবন যাপনের নরক-আনন্দকে আরও তুঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার জন্যেই তাসের হাত-সাফাই জুয়োর ওস্তাদ হয়ে উঠেছিলাম আমি। উকট আনন্দ পেতাম এই নোংরামিতে– সেই সঙ্গে ঝমঝমিয়ে টাকার স্রোত ঢুকে যেত আমার সব কটা পকেটে। টাকার তো আমার অভাব ছিল না।
আমাকে গুড়ের কলসী মনে করে যে নির্বোধগুলো ভনভনিয়ে ঘুরত আমার চারপাশে, তাসের জুয়োয় জোচ্চুরি করে তাদেরকেই দোহন করতাম। এইভাবেই দিনে দিনে উঁচু হচ্ছিল আমার টাকার পাহাড়। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছিলাম জোচ্চুরি খেলায় এবং আবিষ্কার করেছিলাম বহুবিধ কসরৎ।