আমার পয়লা নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এই উইলসন। অথচ একটা দিনের জন্যেও দুচক্ষের বালি মনে করতে পারিনি। এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন ঝগড়া হয়নি দুজনের মধ্যে। অথচ কথাবার্তা বন্ধ থাকেনি একটা মুহূর্তের জন্যেও। ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে গো-হারান হেরেছি আমি কিন্তু ও টিটকিরি দেয়নি– নীরবে নিঃশব্দে শুধু বুঝিয়ে দিয়েছে শুধু আমাকেই আমি ওর যোগ্য পাল্লাদার নই কোনো মতেই। রেষারেষি ছিল বটে দুজনের মধ্যে কিন্তু শত্রুতা ছিল না।
মতো সে মেজাজী, দাপুটে, দুর্দান্ত অথচ কখনোই আমার ঘাড় মুচড়ে মাথা নিচু করতে যায়নি। এসব কারণেই ওকে মনে মনে ভয় করতাম, সমীহ করতাম, ওর সম্বন্ধে অগাধ কৌতূহলে ফেটে পড়তাম। সব মিলিয়ে স্কুল জীবনে আমরা দুজনে ছিলাম একটা প্রচন্ড জুটি। প্রবল প্রতাপের মানিকজোড়।
অথচ আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলতে কখনোই ছাড়েনি আমার এই হুবহু জোড়া-টি। চোট দিয়ে গেছে স্রেফ মজা করার ভঙ্গিমাতে –কিন্তু দাগা দিয়েছে মনের একদম ভেতরে। শত্রুতার ছিটেফোঁটাও থাকত না এসব গাড়োয়ালি ঠাট্টা ইয়ার্কির মধ্যে। আমি কিন্তু পাল্টা ঘা মারতে পারতাম না। ঠিক ওরই কায়দায়। আগেভাগে আঁচ করে নিত উইলসন।
যত রেখে ঢেকেই ফন্দি আঁটি না কেন– ওর তা অজানা থাকত না কখনো। জন্মসূত্রে কিছু ত্রুটি আছে আমার শরীরের গঠনে ও তা জানত। এগুলোকে নিয়ে মস্করা করাটা ঠিক নয়। কেউ তা করত না। কিন্তু ও ঠিক এসব ব্যাপারেই বেশি উৎসাহ দেখাত- যেমন, চাপা ফিসফিসানির স্বরে কথা বলা আমার স্বভাব। আমার গলার দোষও বলতে পারেন। উইলসন ঠিক এভাবে, চাপা ফিসফিসানির সুরে কথা বলে যেত আমার সঙ্গে।
শুধু এই নয়, আমাকে খোঁচা মারা আরও অনেক পন্থা উদ্ভাবন করেছিল এই উইলসন। ঠিক আমার মতো কেউ হাঁটুক, কথা বলুক- এটা সহ্য করতে পারতাম না কোনদিন। বিশেষ বিশেষ কিছু শব্দ অন্য কেউ বললে আমার পিত্তি জ্বলে যেত। এগুলো ছিল আমার একেবারেই নিজস্ব। উইলসন অনায়াসে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করত, একই ভঙ্গিতে হাঁটত, একইভাবে কথা বলত। নাম যার এক, একই দিনে যার একই স্কুলে আগমন, সে যদি এভাবে আমাকে নকল করে যায় দিনের পর দিন মাথা কি ঠিক রাখা যায়?
তখনও জানতাম না –দুজনের বয়সও এক। শুধু দেখতাম, মাথায় দুজনেই সমান ঢ্যাঙা, মুখের চেহারাও বলতে গেলে একই রকম– কথাও বলত আমার কথা বলার ঢঙে চাপা ফিসফিসানির সুরে । ও জানত, এসব ব্যাপারই আমার অপছন্দ, রেগে যাচ্ছি মনে মনে তা সত্ত্বেও খুব সূক্ষ্মভাবে খোঁচা মেরে যেত আমার মনের একদম মধ্যিখানে। তাইতেই ওর তৃপ্তি। তাইতেই ওর শান্তি।
আমি যে ধরনের জামাকাপড় পরতাম, সেগুলোকে পর্যন্ত নকল করত এই উইলসন। হুবহু আমি হয়ে হাঁটত, হাসত। কথা বলত আমারই ভাঙা গলার অনুকরণে। কাহাতক এই ব্যঙ্গ সহ্য করা যায়?
অথচ একে ঠিক ব্যঙ্গও বলা যায় না। ও তো পাঁচজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমার নকল সাজতে যায়নি। শুধু আমাকে গোপনে বুঝিয়ে দিয়েছে অনায়াসেই ও আমার সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারে আমাকে ছাড়িয়েও যেতে পারে।
ব্যাপারে জিতে গিয়ে সবার সামনে নিজেকে জাহির করতে চায়নি– জয়ের পুরস্কার ছিল ওর কাছে পরম তাচ্ছিল্যের ব্যাপার-কিন্তু আড়ালে আমাকে ঘা মেরে বুঝিয়ে দিয়েছে, পদে পদে এভাবেই ও জয়ের মুকুট পরে যাবে আমাকে একধাপ নিচে নামিয়ে রাখবে। তখন দেখেছি ওর ঠোঁটের কোণে অতি মিহি এবং তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের হাসি। আমার মনের ভেতরে ভয়ানক বিষ ছোবল মেরে মেরে ঢুকিয়ে দিয়ে ও যে কী আনন্দ পেত তা বলে বোঝাতে পারব না।
আগেই বলেছি আমার সব কাজে বাগড়া দিলেও এই উইলসনই কিন্তু আমাকে বিপদ-আপদ থেকে আগলেও রাখত। যত দিন গেছে, ততই দেখেছি, ওর এই উপদেশ দেওয়ার ঝোঁকটা বেড়েই চলেছে। উপদেশগুলোও হতো নিখাদ বয়েসের অনুপাতে সব দিক দিয়েই অদ্ভুতভাবে অনেক জ্ঞান আর বুদ্ধি মাথার মধ্যে ঠেসে রেখে দিয়েছিল উইলসন।
তখন জ্ঞানবুদ্ধির ফোয়ারা ছুটিয়ে দিত আমার ওপর। আজ বুঝতে পারছি, ওর সেই ধারালো বুদ্ধির কথামতো যদি জীবনটাকে চালাতাম, তাহলে এত ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। অনেক সুখে থাকতাম।
যাহোক উইলসনের এই খবরদারি শেষ পর্যন্ত চরমে উঠল। আর আমি মুখ বুজে সয়ে যেতে পারলাম না। মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে গেছি রোজই। মুখের ওপরেই বলে দিয়েছি, ঔদ্ধত্য সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। স্কুল জীবনের প্রথম দিকে মোটামুটি একটা বনিবনা ছিল দুজনের মধ্যে আগেই তা বলেছি।
কিন্তু শেষের দিকে ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠল সম্পর্ক। ধীর স্থিরভাবে ও যতই খবরদারি চালিয়ে গেছে আমার ওপর, ততই বিদ্বেষ জমাট হয়েছে আমার মনের মধ্যে। ধীরে ধীরে বিদ্বেষের বিষ ঘৃণার রূপ নিয়েছে। মনে প্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করেছি উইলসনকে। ও তা লক্ষ্য করেছে বিশেষ একটা ঘটনার সময়ে এবং তার পর থেকেই এড়িয়ে থেকেছে আমাকে, অথবা এড়িয়ে থাকার অভিনয় করে গেছে।
যতদূর মনে পড়ে, প্রায় এই সময়েই, একবার কি একটা ব্যাপারে ভয়ানক কথা কাটাকাটি হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। রেগে গেলে আমি কোনোদিনই মাথা ঠিক রাখতে পারি না সেদিনও পারিনি। কিন্তু রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম উইলসনকেও মাথা গরম করে ফেলতে দেখে। আর ঠিক তখনি ও যেভাবে যে ভাষায় আমার সঙ্গে ঝড়ের বেগে কথা চালিয়ে গেছিল, তার সঙ্গে আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছিলাম আমার একদম ছেলেবেলার দিনগুলোর। ভীষণভাবে চমকে উঠেছিলাম আসলে এই কারণেই।