আমি জানি, মৃত্যু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। মৃত্যু যখন এগিয়ে আসে, তখন তার করাল ছায়া পড়ে আগেই। সেই ছায়া পড়েছে আমার ওপর। মন মেজাজ তাই ঝিমিয়ে পড়েছে। নারকীয় সেই উপত্যকার মধ্যে আমি যখন দিশেহারা, তখন পাঁচজনের অনুকম্পা চেয়েছিলাম আকুলভাবে; এক ফোঁটা সহানুভূতি আদায়ের জন্যে নানা ছল চাতুরি করে জাতভাইদের বোঝাতে চেয়েছিলাম, অদ্ভুত কতকগুলো ঘটনা আমাকে টেনে এনেছে এই অবস্থায় আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই; এ-সব ঘটনার ওপর মানুষের কোনো হাত নেই- এমন ধারণাটাও ঢোকাতে চেয়েছিলাম জাতভাইদের মগজের মধ্যে। ভুল করেছি ঠিকই, ঘটনা পরস্পরার গোলাম হয়ে গিয়ে নরক-কুন্ডে হাবুডুবু খাচ্ছি কিন্তু সবাই মিলে হাত লাগিয়ে যদি আমাকে টেনে তোলে, তাহলে আবার সুখের মুখ দেখতে পাবো, ভুলের মরীচিকা মিলিয়ে যাবে সত্যিকারের মরুদ্যানে পৌঁছে যাব।
প্রলোভনই মানুষকে অধঃপাতে নিয়ে যায়। কিন্তু আমার মতো অধঃপতন আর কারও হয়নি। এত কষ্টও কেউ পায়নি। ঠিক যেন স্বপ্নের ঘোরে রয়েছি। তিল তিল করে মরছি। অতি বড় দুঃস্বপ্নেও যে বিভীষিকা। আর রহস্যকে কল্পনা করা যায় না– আমি সেই অবিশ্বাস্য আতঙ্ক আর প্রহেলিকার বলি হতে চলেছি নিরতিসীম নিষ্করুণভাবে!
আমি যে জাতের মানুষদের মধ্যে জন্মেছি, কল্পনাশক্তির বাড়াবাড়ি আর ঝট করে ক্ষেপে ওঠার দুর্নাম তাদের আছে। ছেলেবেলা থেকেই বংশের নাম রেখেছি এই দুই ব্যাপারেই। আমার দুর্বার কল্পনা বাগ মানে না। কিছুতেই; ঠিক তেমনি মাথায় রক্ত চড়ে যায় যখন তখন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুর্বার হয়ে উঠেছে এই বদ দোষগুলো। তাতে বন্ধুবান্ধবদের অশান্তি বাড়িয়েছি, নিজেরও ক্ষতি করেছি। আমার ইচ্ছের ওপর কারো ইচ্ছেকে মাথা তুলতে দিইনি, অদ্ভুত খেয়াল খুশি নিয়ে মেতে থেকেছি, প্রচন্ড ঝোঁকের মাথায় অনেক কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি করেছি। আমার বাবা আর মা-এর মন এবং শরীর তেমন মজবুত নয়; তাই কিছুতেই রাশ টেনে ধরতে পারেননি আমার দুর্দান্তপনার।
খারাপ কাজে আমার প্রবণতা দিনে দিনে লক্ষমুখ নাগের মতো ফনা মেলে ধরেছে– তাঁরা সামাল দিতে পারেননি নিজেদের ধাত কমজোরি বলে। চেষ্টা যে করেননি, তা নয়। কিন্তু সে চেষ্টার মধ্যে জোর ছিল না। বজ্জাত ঘোড়াকে লাগাম পরাতে গেলে কায়দা জানা দরকার। ওঁনারা তা জানতেন না। ভুল করেছিলেন বলেই আমাকে ঢিট করতে তো পারলেনই না– উল্টো জিতে গিয়ে আমি আরও উদ্দাম হয়ে উঠলাম। তখন থেকেই কিন্তু আমার ওপর আর কারও কথা বলার সাহস হয়নি। আমি যা বলব, তাই হবে। আমি যা চাই, তাই দিতে হবে। যে বয়েসে ছেলেমেয়েরা বাবা মা-এর চোখে তাকাতে পারত না –সেই বয়স থেকেই আমি হয়ে গেলাম বাড়ির সর্বেসর্বা। আমিই সব। আমার ওপর আর কেউ নেই।
স্কুলের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা বিরাট বাড়ি। রাণী এলিজাবেথের আমলের প্রাসাদ। ইংল্যান্ডের একটা ছায়ামায়ায় ভরা কুহেলী ঘেরা গ্রাম। সেখানকার গাছপালাগুলো দৈত্যদানবের মতো আকাশছোঁয়া আর ভয়ানক; হাড়গোড় বের করে যেন দাঁত খিঁচিয়েই চলেছে সবসময়ে। সেখানকার সব কটা ইমরাতই বড় বেশি প্রাচীন। স্বপ্ন দেখছি বলে মনে হয়। মনের জ্বালা জুড়িয়ে আসে। এই মুহূর্তে ছায়াস্নিগ্ধ পথগুলো শান্তির ছায়া ফেলছে আমার মনের মধ্যে। পথের দুপাশে ঘন গাছের সারি। ঠান্ডা হাওয়ায় যেন গা জুড়িয়ে আসে। নাকে ভেসে আসছে ঝোঁপঝাড়ের সোঁদা গন্ধ হাজার হাজার ফুলের সৌরভে মনে ঘনাচ্ছে আবেশ। দূরে বাজছে গির্জের ঘণ্টা। গুরুগম্ভীর নিনাদ রোমাঞ্চকর আনন্দের শিহরণ তুলছে। আমার অণু-পরমাণুতে। আমি বিভোর হয়ে যেন স্বপনের ঘোরে দেখছি ঘণ্টায় ঘন্টায় সময়ের বাজনা বাজিয়ে গথিক ভাস্কর্যের বিশাল ওই গির্জে সজাগ প্রহরা দিয়ে চলেছে ধূসর পরিবেশে ঘুমন্ত প্রাসাদের পর প্রাসাদকে।
মনে পড়েছে স্কুলের ছোট ঘটনাগুলো। এত কষ্টে আছি যে খুঁটিয়ে সব কথা বলতে পারব না। সে ক্ষমতা আর নেই। তবে হ্যাঁ, তখন যে ব্যাপারগুলোকে তুচ্ছ আর হাস্যকর মনে হয়েছিল, পরে বুঝেছিলাম, সেগুলো আমোঘ নিয়তির পূর্ব ছায়া। নিষ্ঠুর নিয়তির সেই ছায়াভাস এখন আমার দিকদিগন্ত জুড়ে রয়েছে। আমি শেষ হতে চলেছি।
আগেই বলেছি, স্কুল বাড়িটা রীতিমতো বুড়ো। ছিরিছাদের বালাই নেই বাড়ির নকশার মধ্যে। মাঠময়দানের কিন্তু অভাব নেই। নেচেকুঁদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়ি আর মাঠ-টাঠগুলোকে ঘিরে রেখেছে খুব উঁচু একটা নিরেট ইটের পাঁচিল। পাঁচিলের মাথায় চুন-সুরকি বালির পুরু পলস্তারা। সেই পলস্তারায় গাঁথা রয়েছে খোঁচা খোঁচা ভাঙা কাঁচ। পুরো তল্লাটটা কেল্লার মতো করে তৈরি। আমাদের কাছে মনে হতো ঠিক যেন একটা পেল্লায় কয়েদখানা। এবং পাঁচিলের ভেতরের অঞ্চল টুকুই ছিল আমাদের জগৎ। হপ্তায় তিনবার দেখতে পেতাম পাচিলের বাইরের জগক্টাকে।
শনিবার বিকেলে দুজন মাতব্বরের সঙ্গে দল বেঁধে হন হন করে হাঁটতে যেতাম আশপাশের মাঠে। রবিবারে বেরোতাম দুবার একইভাবে মাতব্বর দুজন চরাতে নিয়ে যেত স্কুলের সব্বাইকে।
একবার বেরোতাম সকালে মাঠে-মাঠে চর্কিপাক দিতে; আর একবার বেরোতাম সন্ধ্যানাগাদ তখন যেতাম গাঁয়ের একমাত্র গির্জের উপাসনায় অংশ নিতে। গির্জার পুরোহিত ছিলেন আমাদেরই স্কুলের অধ্যক্ষ।