কেউ কোনো কথা বলছিলেন না। নীরবে তারা ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনে যাচ্ছিলেন। সিঁড়িতে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হলো। একটা ইঁদুর কিচমিচ করতে করতে দেওয়াল ধরে ছুটল। অন্ধকারটা যেন বুকে চেপে বসেছিল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর মনে সাহস আনতে বিছানা থেকে নেমে মি. হোয়াইট দেশলাইয়ের বাক্সটা নিলেন। জ্বালাতে গিয়ে কাঠিটা নিভে গেল। আর একটা কাঠি জ্বালাতে যাচ্ছেন ঠিক তখন ঠক ঠক করে একটা শব্দ হলো। শব্দটা হলো খুব আস্তে। এত আস্তে যে কষ্ট করে শুনতে হয়। শব্দটা আসছিল ফ্রন্ট ডোর থেকে।
দেশলাইটা তার হাত থেকে পড়ে গেল। তিনি পাথরের মতো নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইলেন। এমন সময় শব্দ হলো আর একবার। তিনি পিছু ফিরলেন। দৌড়ে চলে এলেন ঘরে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। ফের আওয়াজ হলো। ঠক ঠক। সেই শব্দ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল।
চমকে উঠে মিসেস হোয়াইট চিৎকার করে উঠলেন, কীসের শব্দ?
একটা ইঁদুর। সিঁড়িতে আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে গেল, কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন মি. হোয়াইট।
মিসেস হোয়াইট বিছানার ওপর উঠে বসলেন। কান খাড়া। বেশ জোরে ঠকঠক করে শব্দ হলো। সারা বাড়ি গমগম করে উঠল সেই শব্দে।
আমার হার্বার্ট! আমার হার্বার্ট এসেছে, চিৎকার করে উঠলেন মিসেস হোয়াইট।
তিনি দৌড়ে চলে গেলেন দরজার দিকে। তাঁর সামনে তাঁর স্বামী। মি. হোয়াইট স্ত্রীর হাতটা জোর করে ধরে রইলেন।
খসখসে চাপা গলায় বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
যন্ত্রের মতো হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে মিসেস হোয়াইট চিৎকার করে বললেন, আমার বাছা, আমার হার্বার্ট এসেছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম– দু মাইল পথ পার হতে তো একটু দেরি হবেই। হ্যাঁ গো, তুমি কেন আমাকে মিছিমিছি ধরে রেখেছ। আমাকে যেতে দাও লক্ষ্মীটি। দরজাটা খুলতে দাও।
ঈশ্বরের দোহাই, ওকে তুমি আসতে দিও না, ঠক ঠক করে কেঁপে উঠলেন মি. হোয়াইট।
তুমি তোমার ছেলেকে ভয় পাচ্ছ! হার্বার্ট, আমি আসছি। তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে যেতে দাও।
দরজায় আর একবার ঘা পড়ল। আরও একবার। মিসেস হোয়াইট হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিলেন। তারপর ছুটলেন। মি. হোয়াইট সিঁড়ি পর্যন্ত এলেন। বলতে লাগলেন, দোহাই, তুমি যেও না, ফিরে এসো। শিকল খোলার খড় খড় শব্দ কানে এলো তার। নিচের শক্ত খিলটাও আস্তে আস্তে খুলে গেল। তারপর মিসেস হোয়াইটের ক্লান্ত, হাঁফ ধরা গলা ভেসে এলো- ওপরের খিলটার নাগাল পাচ্ছি না। তুমি এসো তো একবার।
তখন মি. হোয়াইট হামাগুড়ি দিয়ে পাগলের মতো মেঝেতে থাবাটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। বাইরে যে আছে, সে ঘরে ঢোকার আগেই থাবাটিকে খুঁজে পেতে হবে।
সারা বাড়িতে ঠক ঠক শব্দ ছড়িয়ে পড়ছিল। মিসেস হোয়াইট টানতে টানতে একটা চেয়ার আনলেন। দরজার সামনে রাখলেন। খিলটা কাঁচ করে খুলে গেল। আর ঠিক সেই সময়েই থাবাটি হাতে ঠেকল মি. হোয়াইটের। তিনি পাগলের মতো চিৎকার করে বলে উঠলেন তার তৃতীয় ও শেষ ইচ্ছার কথা।
হঠাৎ থেমে গেল সেই শব্দ। শুধু রয়ে গেল তার প্রতিধ্বনি। মি. হোয়াইট শুনতে পেলেন চেয়ার সরানোর শব্দ। শুনলেন দরজাটা খুলে গেল। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে।
হতাশায় দুঃখে হাহাকার করে উঠলেন মিসেস হোয়াইট। মি. হোয়াইট দৌড়ে গেলেন স্ত্রীর পাশে। তারপর আস্তে আস্তে গেট খুলে বাইরে এলেন। শব্দহীন, জনমানবশূন্য রাস্তায় শুধু জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আলো। আর কোথাও কিছু নেই, কেউ নেই।
–ডব্লু. ডব্লু জ্যাকবস
উইলিয়াম উইলসন
উইলিয়াম উইলসন নামেই এখন আমাকে চিনে রাখুন। আসল নামটা বলব না। আমার সামনেই রয়েছে এক দিস্তে সাদা কাগজ। আসল নামের কালি দিয়ে কাগজগুলোকে আর নোংরা করতে চাই না। যে নাম শুনলে আমার জাত ভাইরা শিউরে ওঠে, ঘৃণায় মুখ বেঁকায়– সে নাম আপনাকে শুনতে হবে না। সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক কুৎসিত কদাকার কাজ করে বেরিয়েছি, অনেক অপবাদ হজম করেছি, অনেকের সর্বনাশ করেছি। কেউ আমাকে আর চায় না। আমার মত একঘরে এখন আর কেউ নেই। এত কুকর্মও কেউ করেনি। দুনিয়ার মানুষের সামনে আমি তো এখন মরেই রয়েছি। আমার মান-মর্যাদা ধুলোয় মিশেছে, আশা-আকাঙ্ক্ষা শূন্যে মিশেছে; এখন যেন একটা ঘন কালো বিষণ্ণ মেঘ ঝুলছে সামনে; হতাশার এই মেঘের বুঝি আর শেষ নেই; আমার সমস্ত ইচ্ছেগুলোকে আড়াল করে রেখেছে এই ভ্রূকুটি কুটিল কৃষ্ণকায় মেঘ। নিঃসীম নিরাশার এ-রকম দমিয়ে দেওয়া চেহারা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারবে না।
শেষের বছরগুলোর ইতিহাস লিখতে বসিনি। লিখতে পারব কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন। অকথ্য কষ্ট পেয়েছি শেষের দিকে ভাষা দিয়ে সে দুর্ভোগ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা আমার নেই। অপরাধের পর অপরাধ করে গেছি– সে-সবের কোনো ক্ষমাও হয় না। আর তার পরেই ঝুঁকে পড়লাম চরম লাম্পট্যের দিকে। কিভাবে তা ঘটল, শুধু সেইটুকুই লিখব বলেই আজ আমি বসেছি কাগজ-কলম নিয়ে।
মানুষ একটু একটু করে খারাপ হয়। আমি হলাম আচমকা। যা কিছু ভাল ব্যাপার ছিল আমার মধ্যে, সমস্তই টুপ করে খোলসের মতোই খসে পড়ে গেল। অল্প-অল্প খারাপ কাজ করে যাচ্ছিলাম এই ঘটনার আগে; দুম করে শয়তান-শিরোমণি হয়ে যেতেই যেন বিশাল এক লাফ মেরে পৌঁছে। গেলাম নরকের রক্ত-জল করা উপত্যকায়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসবার সুযোগ পেয়েছিলাম একবারই বিশেষ সেই ঘটনাটাই গুছিয়ে বলবার চেষ্টা করছি। একটু ধৈর্য ধরুন।