‘‘পাতরগোঁয়্যাদের প্রতিটি বড়দেওরিকে তার প্রথম সন্তানের জন্মের পর বিধবা হতেই হত, এমনকি সেই সন্তানের প্রথম জন্মদিনে তার হতভাগ্য বাবাকে বলিও দেওয়া হত৷ এতদিন অবধি সেই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি৷ হল এই চাংদেওমাইয়ের সময়ে৷
চাংদেওমাই তাঁর বিবাহিত স্বামীকে খুব ভালোবাসতেন৷ তিনি ঠিক করলেন তাঁর স্বামীকে যে করে হোক বলির হাত থেকে বাঁচাবেন৷
যেদিন বলি হবে, তার আগের রাত থেকেই ওদের গ্রামে উৎসব শুরু হত৷ মদ আর মাংসের এলাহি বন্দোবস্ত থাকত৷ চাংদেওমাই করলেন কী, ওই গোলকপুষ্প লতার একটা তখনও না-ফোটা কুঁড়ি বেটে মদের গামলায় মিশিয়ে দিলেন৷’’
‘‘কেন? গোলকপুষ্পের কুঁড়ি কেন?’’
‘‘আপনার ভাইপোকে কালই বলেছি বাবু, এ দুনিয়ার ফুলই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর পাতাল থেকে তুলে আনা অভিশাপ৷’’ শুকনো গলায় বলল বুড়ো, ‘‘ও ফুল বছরে একবারই ফোটে, কামাখ্যা মায়ের অম্বুবাচী পুজোর দিন৷ তখন সেই ফুল থেকে আশ্চর্য সব ওষুধ তৈরি করা যায়৷ কিন্তু তার আগে যদি ওই ফুল তোলা হয় বাবু, তবে তা সাক্ষাৎ কালসাপের গরল৷ ওই একটিমাত্র ফুলের এত তীব্র বিষ, যা একটা গোটা গ্রামের লোককে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে৷
চাংদেওমাই অবশ্য অতটা চাননি৷ বড়দেওরিরা বংশানুক্রমে এই ফুলের ব্যবহার জানতেন৷ তিনি ততটাই প্রয়োগ করেছিলেন, যতটা করলে এক রাতের জন্য গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে থাকে৷ তাঁর মতলব ছিল যে সেই সুযোগে তিনি তাঁর স্বামী আর কন্যাকে নিয়ে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রাম ছেড়ে, সমাজ ছেড়ে অনেক দূরে অন্য কোথাও চলে যাবেন৷
কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা ফলল না৷ বড়দেওরির কাজে যারা সাহায্য করে, তাদের বলে সারুদেওরি৷ বড়দেওরির মতো এরাও ছিল মেয়ে৷ দুই সারুদেওরির কোনো কারণে চাংদেওমাই-এর ওপর সন্দেহ হয়৷ সেই রাতে পুরো গ্রাম হুল্লোড় করে মদ-মাংস খেলেও তারা ওসব না ছুঁয়ে আড়াল থেকে নজর রাখছিল চাংদেওমাই-এর ওপর৷
মাঝরাতে যখন চাংদেওমাই চুপিচুপি গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন সেই দুই সারুদেওরি তাঁদের পথ আটকে দাঁড়ায়৷ পাতরগোঁয়্যাদের কাছে সমাজ ছেড়ে চলে যাওয়া ছিল মস্ত বড় অপরাধ, নিজেদের গোষ্ঠীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল৷ সেখানে স্বয়ং বড়দেওরি নিজে ওদের প্রথা অমান্য করে স্বামীকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন, সে কত বড় অনর্থ!
সেই রাতে বড়দেওরি আর তাঁর স্বামীর সঙ্গে দুই সারুদেওরির প্রবল কথা কাটাকাটি হয়৷ উত্তেজনার মাথায় বড়দেওরি তাঁর দুই বিশ্বস্ত সহচরীকে কোনো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন করে বসেন৷’’
এতটা বলে আমাদের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাল বুড়ো৷ কাকা বললেন, ‘‘কী হল দাদামশাই, থামলেন কেন?’’
‘‘আর তারপরেই নেমে এল কাউরীবুড়ির কোপ৷’’
এবার আর আমরা কেউ কোনো প্রশ্ন করলাম না বুড়োকে৷
‘‘সেই রাতেই আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে এল কাউরীবুড়ির অনুচরেরা৷ তারা এই দুনিয়ার কাক নয় বাবু, সাক্ষাৎ নরক থেকে উঠে আসা রাক্ষসের দল৷ তারা প্রথমেই খুবলে নিল অচেতন হয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখ৷ বিষমদের নেশায় ঝাঁঝে বেসামাল হয়ে ছিল ওরা, কিছুতেই কিছু আটকাতে পারল না৷ সেই কাকেদের দল চাংদেওমাইয়ের চোখের সামনে একটু একটু করে ছিঁড়ে খেল জ্যান্ত মানুষগুলোকে৷
চাংদেওমাই বুঝতে পেরেছিলেন কী হতে চলেছে৷ কিন্তু তাঁর আর কিছু করার ছিল না৷ নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাঁকে করতেই হত৷ নিজের জাদুবিদ্যার জোরে তিনি নিজের স্বামীকে সেই রাক্ষুসে কাকদের হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা করে গ্রামের বাইরে বার করে দিলেন৷ বলে দিলেন তিনি যেন কাল এসে তাঁদের মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যান৷
আর চাংদেওমাই তাঁর মেয়েকে নিয়ে রয়ে গেলেন গ্রামের মধ্যে৷ চারিদিকে এত মৃত্যুর হাহাকার দেখে তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরি চাংদেওমাই৷ তিনি তাঁর জানা সমস্ত জাদুমন্ত্র দিয়ে নিজের সন্তানকে সুরক্ষিত করলেন৷ তারপর তার মাথায় একটি চুমো খেয়ে দেওথানের উঠোনের অশ্বত্থগাছ থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়লেন!’’
আমরা সবাই স্তব্ধ৷
স্তব্ধতা ভাঙলেন কাকাই৷ গলাটা একটু খাঁকরে যে প্রশ্নটা করলেন, তাতে বুঝতে পারলাম কেন লোকটাকে আমি এত শ্রদ্ধা করি৷
‘‘একটা কথা বলুন তো দাদামশাই৷ এই কাহিনি আপনি জানলেন কী করে?’’
‘‘আমার বাপ-দাদাদের থেকে বাবু৷ এ ভারী গোপন কাহিনি৷ তাঁরা আমাদের এও বলে গেছেন যে আমাদের পরিবারের বাইরের যেন কেউ…’’
‘‘আপনার বাপ-দাদারাই বা এই গল্প জানলেন কী করে?’’
বুড়ো বোধহয় প্রশ্নটা বোঝেনি৷ হাঁ করে চেয়ে রইল কাকার দিকে৷ আমিও বুঝতে পারলাম না কাকা হঠাৎ এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করছেন কেন৷
সংশয়ের অবসান হল কাকার পরের প্রশ্নেই৷
‘‘আপনার কথামতো পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে সেই রাতে যা ঘটেছিল সেটা কারও জানার কথা নয়৷ সবাই তো মরে গেছে, বলবে কে? আর এদিকে পরাগ যে গল্পটা ভবতারণকে বলেছিল তাতেও তো বাইরের অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়৷ আপনার বাপ-দাদারা জানলেন কী করে?’’
এইবার প্রশ্নের কারণটা বুঝলাম৷ বুড়োর মুখ অন্ধকার হয়ে এল৷ পরাগের মুখেও একটা ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর ভাব৷