‘‘কোন দুটো সূত্র কাকা? জানতে পারি?’’
‘‘প্রথম হচ্ছে ওই পাতরগোঁয়্যাদের শেষ গল্পটা৷ কী হয়েছিল ওদের? কী এমন ভয়ানক অপরাধ করেছিলেন ওদের সেই বড়দেওরি, যে, তার জন্য ওদের পুরো জাতটাই ধ্বংস হয়ে গেল?’’
‘‘আর দ্বিতীয়টা?’’
‘‘সেদিন মাধুরীকে রেপড হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কে এসেছিলেন? কে সেই বৃদ্ধা?’’
‘‘সে তো মাধুরী বললই যে ও চিনতে পারেনি…’’
আমার দিকে গভীরভাবে তাকালেন কাকা৷ তারপর বললেন, ‘‘ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছ তত সহজ নয় ভাইপো৷ এর মধ্যে অনেক জটিলতা আছে৷ ওটা না জানলে এই রহস্যের জট ছাড়াতে পারব না হে৷ বাকি সবই আমার মোটামুটি জানা৷’’
কথাটা আমার বিশ্বাস হতে চায় না৷ ‘‘কী বলছেন কী কাকা? বাকি সবই জেনে গেছেন আপনি?’’
গম্ভীর মুখে মাথাটা দুবার ওপর-নীচে করলেন কাকা৷ ‘‘জেনে গেছি বই কি ভাইপো৷ আর যদি মাথা ঠান্ডা করে নিজেই নিজেকে কতগুলো প্রশ্ন করতে, তাহলে বুঝতে পারতে কথাটা কেন বলছি আমি৷’’
‘‘যেমন?’’ চ্যালেঞ্জের সুরে বললাম আমি৷
‘‘এত ভিজে পোড়া কাঠের গন্ধ পাও কেন ভবতারণ, ভেবেছ কখনও? কাউরীবুড়ির মন্দিরে এত কাক কেন? পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির প্রথম সন্তান জন্মাবার পর বিধবা হতে হতই কেন? সত্যি বলো তো ভাইপো, তুমি কি কিছুই আন্দাজ করতে পারোনি?’’
বেকুবের মতো মাথা নাড়লাম৷
কাকা ফের চলতে শুরু করলেন৷
যেখানে রিকশা থেকে নেমেছিলাম, সেখান থেকে পরাগের বাড়ি যেতে সময় লাগল ঠিক দশ মিনিট৷ সহজ রাস্তা, গুলোবার চান্সই নেই৷
পরাগ বাড়িতেই ছিল৷ আমাদের বসতে বলল দাওয়াতে৷ লক্ষ করলাম কালকের তুলনায় একটু গম্ভীর হয়ে আছে ছেলেটা৷ আমাদের দেখে একটি ছোট মেয়েকে বড় ঠাকুর্দাকে নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিল পরাগ৷ মেয়েটি উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলছিল৷ বেজার মুখে ভেতরে গেল বুড়োকে ডেকে আনতে৷
এই অবসরে কাকার সঙ্গে পরাগের আলাপ করিয়ে দিলাম৷ পরাগ স্মার্টলি হ্যান্ডশেক করে ‘‘হ্যালো’’ বলতেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল৷ কাকা ওর হাত কিছুক্ষণ ধরে থেকে দুম করে বলে বসলেন, ‘‘মেয়েটার উদ্দেশ্য ভালো না ভাই, দয়া করে ওর জালে ফাঁসবেন না৷ আপনাকে খেলাচ্ছে ও৷ সোনার হার, দামি রিস্টওয়াচ এসব দিয়েছেন ঠিক আছে৷ তবে আর কোনো আর্থিক চাহিদা মেটাতে যাবেন না কিন্তু, আখেরে পস্তাবেন৷ এ মেয়ে ভালো নয়, আপনাকে ফতুর করে উড়ে গিয়ে অন্য ডালে বসবে৷ আর হ্যাঁ, অফিসের ক্যাশ ভাঙার কথা ভুলেও ভাববেন না৷ যে সাবানে অফিসের ক্যাশবাক্সের চাবির ছাপ তুলে নিয়ে এসেছেন, ওটা ফেলে দিন৷ আপনার বড় সাহেব কিন্তু এসবের আঁচ পেয়েছেন, আপনার ওপর নজর রেখে চলেছেন উনি৷ বিন্দুমাত্র বেচাল দেখলেই আপনি জেলে যাবেন, লিখে রাখুন৷’’
আমি তো স্তব্ধ! তবে দেখার মতো অবস্থা হল পরাগের৷ দশ সেকেন্ড মতো হাঁ করে কাকার দিকে চেয়ে রইল সে৷ তারপর কাটা কলাগাছের মতো কাকার পায়ে পড়ে গেল, ‘‘স্যার…স্যার…আপনি ভগবান স্যার৷ জালে আটকে গেছি স্যার৷ বেরোতে পারছি না৷ দয়া করে বাঁচান আমাকে৷’’
কাকা ঝট করে নীচু হয়ে পরাগের কাঁধে হাত দিয়ে তুলে ধরলেন ওকে৷ তারপর বললেন, ‘‘টাকা ব্যাপারটা ভালো, তবে যদি সৎপথে আসে, তবেই৷ আর মেয়েটা সত্যিই ভালো না৷ কী করে সে?’’
‘‘শিলিগুড়ির ডান্সবারে কাজ করে৷ ডান্সগার্ল৷’’
‘‘আমার গণনা বলছে মেয়েটি কোনো আত্মঘাতী, স্বজাতিদ্রোহী কাজের সঙ্গে যুক্ত৷ এর সঙ্গে থাকলে আপনার অপঘাত মৃত্যু অনিবার্য৷’’
‘‘আমি পারছি না স্যার, মাইরি বলছি৷ আজকাল সত্যিই ওর রকমসকম আমার অদ্ভুত ঠেকছে৷ আমি চাইলেও এই জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারছি না স্যার৷ ও শুধু আমাকে থ্রেট দিচ্ছে, বলছে যে আমার সবকিছু ও এখানে এসে ফাঁস করে দেবে৷’’
কাকা বরাভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুললেন, ‘‘সেসব আমি দেখে নেব ভাই৷ আপনি শুধু কথা দিন, দরকারের সময় আপনি আমাদের সাহায্য করবেন?’’
পরাগ খুব সম্ভবত কাকার পায়ে আবার ডাইভ দিতে যাচ্ছিল৷ আমি আটকালাম, কারণ ততক্ষণে পরাগের বুড়ো ঠাকুর্দা দরজা খুলে বারান্দায় এসে উপস্থিত৷
আমাকে দেখে স্মিত হাসল বুড়ো, তারপর কাকার দিকে দু’হাত তুলে নমস্কার করে বলল, ‘‘এনাকে তো চিনলাম না বাবু৷’’
কাকাও প্রতি-নমস্কার করে হাসিমুখে বললেন, ‘‘পৃথিবীতে কে-ই বা আর অন্য কাউকে ভালো করে চেনে বলুন৷ আমি কে. এন. ভট্টাচার্য, শিলিগুড়িতে থাকি৷ ভবতারণ আমার নিজের ভাইপো বললেই চলে৷ ও বলল কীসব নাকি দামি লতার খোঁজ পেয়েছে, তাই আমার সাহায্য দরকার৷ সুযোগ বুঝে আমিও চলে এলাম এখানে৷ আসামের এই দিকটা আমার দেখা ছিল না কিনা৷’’
বুড়োর মুখে স্মিত হাসি, যেন কেমন একটা ‘‘মিথ্যে কথার দরকার ছিল না বাবু, আমি জানি আপনি কেন এসেছেন’’ মার্কা হাবভাব৷ তারপর সরাসরি বলল, ‘‘বলুন বাবু, কী জানতে চান৷’’
‘‘আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে কী হয়েছিল দাদামশাই? কীসের অভিশাপ দিয়েছিলেন কাউরীবুড়ি?’’
বুড়ো আর পরাগ তো বটেই, আমিও হকচকিয়ে গেছিলাম এমন আক্রমণের সামনে পড়ে৷ কাকাকে চিরকালই দেখে এসেছি ধীরস্থির একজন মানুষ হিসেবে৷ কোনো তাড়াহুড়ো করার লোক তিনি নন৷ সেই তিনিই যে আলাপ-পরিচিতির বালাই না রেখে এমন একটা কামান দেগে বসবেন সে আমরা জানব কী করে?