আমি তাই করলাম৷ শুধু লক্ষ করলাম যে মূর্তির গায়ে সিঁদুরের একটা নতুন পোঁচ৷ আমার কেমন যেন কৌতূহল হল, কোন দেবীর মূর্তি এটা?
একটু একটু করে সিঁদুরের প্রলেপ খুঁটে খুঁটে তুলে ফেললাম৷ মূর্তিটা একটু অদ্ভুত, কোমর থেকে ওপরের দিকটা সাপের মতো, তার পাঁচটা মাথা৷ নীচের দিকটা কোনো মহিলার৷ দেখে মনে হল মনসার মতো কোনো দেবীর মূর্তি৷ ভাবলাম হবেও কেউ, হয়তো ওদের পারিবারিক দেবতা৷
সেদিন রাতে বেশ কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখলাম, তবে তার কোনোটাই ভয়ংকর কিছু না৷ তবে প্রবলেম শুরু হল পরের দিন সকাল থেকে৷
সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে অনির্বাণের সঙ্গে একচোট ঝগড়া হয়ে গেল৷ অথচ তেমন কিছু ছিল উপলক্ষ্য ছিল না, নিতান্তই মামুলি ব্যাপার৷ অথচ ঝগড়া করতে করতে দুম করে আমার মাথাটা এমন গরম হয়ে গেল যে, এক টান মেরে খাবারদাবার সব ফেলে দিয়ে দুম দুম করে উপরের ঘরে চলে এলাম৷
খানিক পরে মাথাটা ঠান্ডা হতে খুব অনুতপ্ত বোধ হতে লাগল৷ এমনিতে আমি খুব ঠান্ডা মাথার মেয়ে৷ অমন একটা তুচ্ছ কারণে অতটা রেগে যাওয়া মোটেও উচিত হয়নি৷ নীচে গিয়ে সব গুছিয়েগাছিয়ে অনির্বাণকে সরি বলে এলাম৷
কিন্তু সেখানে গল্পের শেষ না, শুরু!
লক্ষ করতে শুরু করলাম যে দিভাই আর অনির্বাণের মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা আছে৷ একটু অস্বাভাবিক৷’’
‘‘অস্বাভাবিক বলতে?’’ ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না আমার কাছে৷
‘‘কীরকম অস্বাভাবিক সেটা আপনাকে বোঝানো একটু মুশকিল৷’’ একটু অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে বসল মাধুরী, ‘‘ভাইবোনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা থাকবে সে আর এমন কী, তাই না? আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম৷ কিন্তু দু’দিনের মধ্যে বুঝলাম যে ব্যাপারটার মধ্যে একটা অ্যাবনর্ম্যাল কিছু আছে৷ আমার চোখে ব্যাপারটা একটু কেমন জানি অন্যরকম মনে হতে লাগল৷’’
‘‘কীরকম?’’ আমি একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলাম৷
‘‘ওটা আপনাকে বোঝানো একটু মুশকিল দাদা৷ আমরা মেয়েরা বুঝতে পারি৷ চোখের ইশারায়, দৃষ্টিতে, অনির গায়ে মাথায় দিভাইয়ের হাতের ছোঁয়ায়… মোটমাট আমার মাথার মধ্যে কে যেন বলতে লাগল ব্যাপারটা খুব একটা স্বাভাবিক না৷
এদিকে শুরু হল অন্য সমস্যা৷ রোজই আমাদের মধ্যে কথায় কথায় তুমুল অশান্তি আর ঝামেলা শুরু৷ প্রতি কথায় বাকবিতণ্ডা হতে হতে সে প্রায় মারামারি কাটাকাটি হওয়ার মতো অবস্থা৷ অনির্বাণ খুব ঠান্ডা মাথার লোক, তাকে আমি কোনোদিন রাগতে দেখিনি৷ সেও গলা উঁচিয়ে সমানে ঝগড়া করে যেতে লাগল৷ দিভাই এক-দুবার শান্ত করতে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন৷
সেদিন দুপুরে সিঁদুর পরতে গিয়ে ফের সেই ডাক শুনলাম, তবে আগের থেকে অনেক ক্ষীণ৷ তখন আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতেই পারছিলাম না৷ স্নান করে আসা সত্ত্বেও দেখি মাথার চুলগুলো হাওয়ায় সাপের মতো উড়ছে৷ চেহারার মধ্যে একটা ক্রুদ্ধ রুক্ষ ভাব৷ নিজেকে কখনও ওই চেহারায় আগে দেখিনি৷
সিঁদুর পরে একটু মাথাটা ঠান্ডা করে ভাবার চেষ্টা করলাম যে কেন আমি এরকম করছি৷ যে মানুষটাকে আমি নিজে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, তার সঙ্গে এত অশান্তি কেন? ভেবে দেখতে গেলে ঝগড়ার কারণগুলোও কিন্তু খুবই তুচ্ছ৷ যেমন নুনদানিটা কেন ওখানে রাখা আছে, কাঁটাচামচ এগিয়ে দেওয়ার সময় ও কেন মাথার দিকটা ধরে এগিয়ে দিল, বাথরুমে জল পড়ে আছে কেন, এইসব৷ এসব সামান্য, অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার কথা আমি ভাবতেও পারি না৷ অথচ ঠিক সেটাই ঘটছে৷
সেদিন থেকে দিভাইয়ের আচরণও আমার কাছে আরও বিসদৃশ ঠেকতে লাগল৷ অনির মুখে খাবার লেগে আছে, উনি বুকের আঁচল খসিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছেন৷ ভাই ঝগড়া করতে করতে মুখ ভার করছে, উনি ভাইয়ের মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন৷’’
এতটা বলেই একটু সংকুচিত হয়ে পড়ল মাধুরী, ‘‘দাদা, আপনি কি আমাকে পারভার্ট বলে ভাবছেন? ডার্টি মাইন্ড?’’
শাস্ত্রে বলে স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম ভগবানেরও অগম্য৷ যে মেয়েটাকে আমি দু’দিনের বেশি চিনি না তার চারিত্রিক গুণাবলির ব্যাপারে এখনই কোনো সার্টিফিকেট দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে চুপ করে রইলাম৷
‘‘বিকেলের দিকে ভাবলাম একটু বেড়িয়ে আসি, বাড়ির গুমোট ভাবটা কাটবে৷ একটা রিকশা করে অনির্বাণকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধারে হাওয়া খেতে গেলাম৷ লক্ষ করলাম রিকশাতে অনির্বাণ কেমন যেন কাঠ হয়ে বসে আছে৷ আমার খুব খারাপ লাগল, ভাবলাম হয়তো সকালের ঝগড়াঝাঁটির জের৷ এক-দুবার ওর হাতটা ধরার চেষ্টা করলাম, কোনো সাড়া পেলাম না৷
সেদিন বেড়ানোটা মোটেও সুখের হয়নি৷ ফেরার পথে রাস্তাতেই একবার কথা কাটাকাটি হয়ে গেল, তাও রিকশাওয়ালার ভাড়া সংক্রান্ত তুচ্ছ একটা বিষয়ে৷ ফিরে এসে খানিকক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে রইলাম দুজনেই৷ সে যাই হোক, খেয়েদেয়ে রাতে শুতে গেছি, এমন সময় মনে হল সারা ঘরে কেমন যেন একটা অদ্ভুত গন্ধ৷’’
‘‘কীসের গন্ধ?’’ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম৷
‘‘কেমন যেন ভিজে কাঠ পোড়ার গন্ধ৷ একটু ভারী, ভ্যাপসা, দম আটকে আসার মতো একটা গন্ধ৷’’
আশা করছিলাম এই উত্তরটাই আসবে৷ তাই বিশেষ চমকালাম না৷
‘‘ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়েও যখন গন্ধটা গেল না, তখন চেষ্টা করলাম গন্ধটা কোথা থেকে আসছে সেটা খোঁজার৷ আঁতিপাঁতি করে মেঝে, খাটের তলা, আলমারির পেছন ইত্যাদি খুঁজেও তার হদিস পেলাম না৷ শেষমেশ ঘরের চারিধারে খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম যে গন্ধটা আসছে কুলুঙ্গি থেকে, যেখানে মূর্তিটা আছে৷