‘‘কিন্তু বাবু, আপনি যে সত্যি বলছেন, সেটা বুঝব কী করে?’’
গতকাল পরাগকে যে কড়া জবাবটা দিয়েছিলাম সেটা মুখে এসে গেছিল৷ কিন্তু ওই যে বললাম, বুড়ো লোকটাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেছিল আমার৷ তা ছাড়া বুড়োর এত কৌতূহল কেন সেটাও তো জানা দরকার৷ বলা যায় না, যে কাজে এসেছি সেটার জন্য লোকটা হয়তো অযাচিতভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল৷ বলা তো যায় না!
হাসিমুখে বললাম, ‘‘প্রমাণ তো সেরকম কিছু নেই দাদু৷ একটা ছবি তুলতে গেছিলাম, তাতেই সেই ভদ্রমহিলা তো এমন হাঁইমাই করে উঠলেন যে…’’
‘‘মহিলা? কোন মহিলা?’’ বুড়োর দৃষ্টি আর স্বর দুটোই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল৷ পরাগ বারান্দার একটা থামে হেলান দিয়ে বসেছিল৷ সেও দেখলাম উঠে বসেছে, চোখে বিস্মিত দৃষ্টি, ‘‘মহিলা? কই, কাল তো কোনো মহিলার কথা বলেননি আমাকে!’’
‘‘কাল আর তোমাকে কিছু বলার সময় পেলাম কোথায়? শুধু তো শুনলাম৷’’
বুড়ো একটু কাছে ঘনিয়ে এল৷ পরাগকে বলল বারান্দা থেকে ভেতরে যাওয়ার সদর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে একবার চারপাশটা ঘুরে দেখে আসতে, কেউ আছে কি না৷ তারপর আমাকে চাপাস্বরে বললেন, ‘‘কীভাবে কোথা থেকে ওখানে গেলেন, কী কী হল সেটা একবার আমাকে আগাগোড়া খুলে বলুন তো বাবু৷’’
পুরো ঘটনাটাই বললাম ওঁকে৷ কিচ্ছু বাদ দিলাম না৷ আমার ওখানে যাওয়া, ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হওয়া, এমনকি পুজোপদ্ধতিটাও৷
কথা শেষ হওয়ার পর দেখি বুড়োর মুখ উত্তেজনায় থমথম করছে৷ পরাগ ভেতর থেকে বুড়োর জন্য হুঁকো মতন কী একটা এনে দিল৷ বুড়ো সেটাতে গুড়ুক গুড়ুক টান দিল দুবার৷ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘জানি না বাবু আপনার বাপ-দাদারা কী কী পুণ্যি করে গেছেন৷ নইলে আজ অবধি কাউরীবুড়ির মন্দিরে কেউ যেতে পেরেছে অথবা গেলে ফিরতে পেরেছে বলে শুনিনি৷ আমার জানাশোনার মধ্যে আপনিই একমাত্র লোক৷’’
‘‘সে কথা তো পরাগও বলছিল বটে৷ কিন্তু কেন বলুন তো?’’
‘‘সে বড় ভয়ংকর জায়গা বাবু৷ মরণ না ডাকলে ওখানে কেউ যায় না৷ আমরা বলি নরকের দরজা৷’’
‘‘নরক? নরক কেন?’’
‘‘সে অনেক কথা বাবু৷ পরাগ আপনাকে যেটুকু জানে শুধু সেটুকুই বলেছে৷ ওর বাইরেও ওই মন্দির ঘিরে যে কত কিছু আছে সেসব আপনার ধারণার বাইরে৷’’
‘‘যেমন?’’
‘‘আপনি কী ভাবছেন, ওই লতা যেমন-তেমন সাধারণ লতা? আপনি তুলে নিয়ে অন্য কোথাও পুঁতবেন আর ও শাকপাতার মতো তরতরিয়ে বেড়ে উঠে ফুল ফোটানো শুরু করবে? সেটি হবার নয় গো বাবু৷’’
সেই মহিলার শেষ কথাটা মনে পড়ে গেল৷ কাউরীবুড়ির কাছে বলি দেওয়া প্রাণীর রক্ত ছাড়া ও ফুল বাঁচে না৷
‘‘শুনুন বাবু, ও ফুল বড় সাংঘাতিক জিনিস৷ ও এ দুনিয়ার ফুলই নয়, সাক্ষাৎ পাতাল থেকে তুলে আনা অভিশাপ৷ ওর মোহে একবার যে পড়েছে তার আর বাঁচার কোনো পথ নেই, তার মহাসর্বনাশ অনিবার্য৷ আমাদের পূর্বপুরুষেরা বলতেন যে কেউ যদি অম্বুবাচীর দিনে গভীর রাতে কাউরীবুড়ির পুজো করে ওই ফুলের রস খায়, তাহলে তার নাকি শয়তানের ক্ষমতা জন্মায়৷ তখন সে মরা মানুষ বাঁচাতে পারে, বাঁজা মেয়েমানুষের পেটে বাচ্চা এনে দিতে পারে, জীয়ন্ত মদ্দাকে ভেড়া বানিয়ে দিতে পারে৷’’
‘‘এসব কে বলেছে আপনাকে?’’
‘‘আমাদের পূর্বপুরুষের থেকে শোনা কথা গো বাবু৷ অবশ্য তারাও কেউ ওই ফুল চক্ষে দেখেনি, শুধু নামই শুনেছে৷’’
‘‘কিন্তু একটা কথা বলুন দাদু, সেক্ষেত্রে তো পাতরগোঁয়্যাদের গোষ্ঠীর সব্বারই অলৌকিক ক্ষমতা থাকার কথা, তাই না?’’
‘‘না বাবু, ওদের সবাই যে গোলকপুষ্পের লতা ইচ্ছেমতো হাতের কাছে পেত তা তো নয়৷ এই লতার চাষ হত খুব গোপনে, বুঝলেন কি না৷’’ বুড়ো আরও খানিকটা ঝুঁকে এল আমার দিকে, যেন কোনো একটা গোপন খবর দিচ্ছে, ‘‘একমাত্র বড়দেওরি আর তাদের পরিবারের মেয়েরা ছাড়া কেউ জানতই না এই ফুলের পরিচর্যা কী করে করতে হয়৷’’
‘‘আর তাদের যদি বিয়ে হয়ে যেত অন্য গোষ্ঠীর কোনো ফ্যামিলিতে? তারা জেনে যেত না?’’ প্রশ্ন করি আমি৷
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বুড়ো, ‘‘না বাবু, সেটা হত না৷ কারণ ওদের জন্য নিয়ম ছিল আলাদা৷ বড়দেওরি পরিবারের মেয়েদের বিয়ে হত ওদের সমাজের মধ্যেই৷’’
‘‘কেন? ওদের জন্য অন্য নিয়ম কেন?’’
‘‘কারণ, বড়দেওরির রক্ত যাতে বিশুদ্ধ থাকে৷ অন্য জাতের রক্ত ওরা ভেজাল মনে করত কি না! বড়দেওরির গর্ভে সন্তান এনে দেওয়া কি সাধারণ মানুষের কম্ম?’’
‘‘তাহলে?’’
‘‘ওদের সমাজে একটি সুলক্ষণযুক্ত যুবককে ছোট থেকে এই উদ্দেশ্যেই বড় করে তোলা হত৷ তাকে বলা হত দেওধারী, মানে দেবতাকে ধারণ করেন যিনি৷ তাঁর থেকে পরবর্তী বড়দেওরির জন্ম হবে, সে যে মস্ত পুণ্যের কাজ৷ মহা ধুমধাম করে তাঁর সঙ্গে বড়দেওরির বিয়ে হত৷ তারপর বড়দেওরির গর্ভাধানের খবর এলে তো কথাই নেই! পাতরগোঁয়্যাদের গ্রাম জুড়ে উৎসব৷ বলিদানই চলত প্রায় হপ্তাখানেক ধরে৷ সেসব প্রসাদ পুরো গ্রামে বাঁটোয়ারা হত৷’’
‘‘বাপ রে! তাহলে সন্তান জন্মালে কী করত ওরা?’’
‘‘সেদিন তো আনন্দে পাগল হয়ে যেত ওরা৷ আরও বড় মোচ্ছব হত৷ দেওরিদের বাকি গোষ্ঠীদের সব্বাইকে নেমন্তন্ন করে পাত পেড়ে খাওয়ানো হত, সঙ্গে দেদার মদ৷ সেদিন বড়দেওরির থানে যার যা ইচ্ছে নজরানা দিয়ে যেত৷ সে বড় পুণ্যের দিন৷’’