কলেজের গেটের ঠিক উলটোদিকে একটা পানের দোকান ছিল৷ তার সামনে একটা ভাঙাচোরা বেঞ্চি পাতা৷ ধীরেসুস্থে সেখানে সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে দোকানিকে একটা গোল্ড ফ্লেক দিতে বললাম৷ তারপর দোকানের পাশে ঝুলতে থাকা নারকেলের জ্বলন্ত দড়ি থেকে সেটা ধরিয়ে একটা বুক খালি করা গভীর টান দিলাম৷
তামাক পোড়া ধোঁয়াটা পাক খেতে খেতে আমার বুকের গভীর অন্ধকারে সেঁধিয়ে যেতে থাকল৷ নিকোটিনের প্রথম ধাক্কাটা মগজে পৌঁছোতেই স্নায়ুগুলো সামান্য সজাগ হয়ে উঠল বটে, কিন্তু মাথার জটটা ছাড়ল না৷
সিগারেটটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম৷ কলেজ শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, মেয়েরা সব ভেতরে চলে গেছে৷ সাইকেল আরোহী ছেলেদের দলও এখন ঘরে ফেরার তালে৷ মাথার ওপর আশ্বিনের মিঠে রোদ চড়চড় করছে৷ যদিও আকাশের অর্ধেকটা মেঘে ঢাকা৷ দিন দুয়েকের মধ্যে বৃষ্টি নামবে মনে হয়৷
ভাবলাম একবার নদীর দিকটায় যাই৷ ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে যদি মাথার জটটা একটু ছাড়ে৷ সেইমতো রাঙ্গাগড়া রোডটা ধরলাম৷
তখন তিনসুকিয়ার রাস্তার অবস্থা ছিল খুব করুণ৷ কোনোমতে খানাখন্দ পেরিয়ে সবে নতুনমাটি টি ফ্যাক্টরির কাছে পৌঁছেছি, এমন সময় মনে হল পেছন থেকে কে যেন নাম ধরে ডাকছে না?
সাইকেলটা সাইড করলাম৷ অচেনা-অজানা জায়গায় কে নাম ধরে ডাকে ভাই?
তাকিয়ে দেখি পরাগ বসুমাতারি৷ রাস্তার ওপার থেকে আমার দিকে প্রবল বেগে হাত নাড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে৷ আমাকে দাঁড়াতে দেখে দৌড়ে এল আমার কাছে, ‘‘কী আশ্চর্য! আপনি এখানে? আমি তো আপনার খোঁজে আপনার বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম৷’’
‘‘কী ব্যাপারে?’’
পরাগ গলাটা নামিয়ে বলল ওই কাউরীবুড়ির মন্দিরের ব্যাপারে ও আমাকে একজনের সঙ্গে দেখা করাতে চায়৷ তাতে আমার উপকার হলেও হতে পারে৷
‘‘কে সেই লোক?’’
‘‘আমার বড় ঠাকুর্দা৷’’
জানা গেল পরাগের বড় ঠাকুর্দা, অর্থাৎ ঠাকুর্দার দাদার বয়েস প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি৷ বুড়োর নাকি টুকটাক হাতুড়ে বিদ্যায় খ্যাতি আছে কিছু৷ এখনও গ্রামে-গঞ্জে লোকজন কাছে আসে জড়িবুটি নিতে৷ তা ছাড়া পুজোপার্বণের দিন দেখে দেওয়া, জলপড়া, বাটি চালানো, ভূত ছাড়ানোর মন্তর, এসবেও বুড়োর হাতযশ খুব৷
কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমার লাভ?
পরাগ জানাল যে ওর বড় ঠাকুর্দা হচ্ছেন দেওরিদের লোককথা বা উপকথার জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বিশেষ৷ ওদের সমাজের হেন গল্প নেই, হেন প্রথা নেই, হেন কাহিনি নেই যা উনি জানেন না৷ কালকে রাতে পরাগ গিয়ে ওঁকে জানিয়েছে আমার কাউরীবুড়ির মন্দিরে যাওয়ার কাহিনি৷ তাতে নাকি তিনি ভীষণ উত্তেজিত৷ আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছেন৷ সদানন্দকাকুকেও উনি ভালোভাবেই চেনেন৷ আজ সকালে নিজেই রওনা দিয়ে দিচ্ছিলেন প্রায়৷ অনেক কষ্টে ওঁকে থামিয়ে আমার খোঁজে বেরোচ্ছিল পরাগ৷ ভাগ্যক্রমে আমাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে যায় ও৷
পরাগের সঙ্গে যেতে কোনো আপত্তি ছিল না আমার৷ কৌতূহলও হচ্ছিল বিস্তর৷
জঙ্গল কেটে বানানো মেঠো রাস্তা পেরিয়ে পরাগের সঙ্গে ওদের গ্রামে পৌঁছোতে সময় লাগল মিনিট বিশেক৷ গ্রাম বললে অবশ্য যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার সঙ্গে মিল সামান্যই৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছোট পাড়া বললেই ঠিক হয়৷ সব একতলা পাকা বাড়ি৷ মাথায় অ্যাসবেস্টসের ছাউনি, এখানে বলে ঢেউটিন৷ পাড়ার পুরুষেরা বোধহয় কাজের ধান্দায় বেরিয়েছে সব৷ আমাকে দেখে বউ-ঝিরা উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করতেই পরাগের ধমক খেয়ে অন্দরে লুকোল৷ বুঝলাম পরাগের বেশ প্রতাপ আছে মহল্লায়৷
পরাগের বাড়িটা গ্রামের একদম শেষে৷ দেখে বোঝাই যায় এরা হল গিয়ে গ্রামের সবচেয়ে সম্পন্ন গৃহস্থ৷ বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বানানো একতলা বাড়ি৷ সামনেটায় খানিকটা ছড়ানো জমি৷ তাতে শাকসবজি চাষ করা হয়েছে৷ চোখের আন্দাজে বুঝলাম যে বাড়ির পেছনের দিকেও বেশ বড় গোছের একটা বাগান-টাগান আছে৷
আমাকে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে বারান্দায় একটা চাটাই পেতে বসতে দেওয়া হল৷ ভেতর থেকে ভারী কাঁসার গ্লাসে ঠান্ডা জল এল, সঙ্গে কিছু স্থানীয় মিষ্টি গোছের জিনিস৷ সেসব খেতে খেতেই দেখি পরাগ হাত ধরে এক বয়স্ক ভদ্রলোককে বাইরে নিয়ে আসছে৷
বড় ঠাকুর্দা এসে বসলেন আমার সামনে৷ আমি উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলাম৷ উনিও কাশতে কাশতে দু’হাত তুলে প্রতি-নমস্কার করলেন৷ হাতের মুঠোয় বেতের লাঠিটি ধরা৷
বুড়োবাবু দেখলাম খিলাড়ি লোক৷ দুম করে প্রসঙ্গটায় ঢুকলেন না৷ আমি কলকাতার লোক শুনে প্রথমে খানিকক্ষণ বাঙালিদের সুখ্যাতি করলেন৷ সুভাষচন্দ্র বসু দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে যে আজ দেশের এই হাল হত না সে কথাটা জোর দিয়ে বললেন৷ কলকাতার এখনকার হালচাল জিজ্ঞেস করলেন কিছু৷ ট্রাম জিনিসটা কী করে ওই ভিড় রাস্তায় চলে সে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন৷ মিঠুন চক্রবর্তীর অভিনয় নিয়ে কিছু উচ্চাঙ্গের আলোচনা হল৷ ততক্ষণে স্টিলের গ্লাসে চা এসে গেছে৷ চায়ের কাপে একটা চুমুক দিলেন প্রথমে৷ তারপরেই বলিরেখাঙ্কিত মুখখানি তুলে, সরু চোখদুটো আরও সরু করে প্রশ্ন করলেন—
‘‘তারপর বাবু, আমার নাতি যা বলছে সেটা ঠিক নাকি, অ্যাঁ?’’
বুড়োকে আমার বেশ পছন্দ হয়ে গেছিল৷ হাসিমুখে বললাম, ‘‘হ্যাঁ, একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক৷’’