‘‘বলো, তারপর কী হল?’’
‘‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম, জানেন?’’
‘‘কী স্বপ্ন?’’
‘‘দেখলাম যে আমি যেন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছি৷ আমার পেছনে কারা যেন চিৎকার করে আমাকে বারণ করছে সেখানে যেতে৷ কিন্তু আমি কিছুতেই তাদের বারণ শুনছি না৷ আমি এগিয়ে চলেছি সেই জঙ্গলের মধ্যে৷ এগিয়ে চলেছি বলা ভুল, কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে জঙ্গলের আরও ভেতরে…আর…আর…’’
‘‘আর কী?’’
‘‘আর আমার চারিপাশে গাছের ডালে বসে আছে অসংখ্য কাক৷ তাদের লাল লাল চোখ৷ আর তারা একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকেই৷’’
সোজা হয়ে উঠে বসলাম৷ কী বলছে কী মেয়েটা?
মাধুরী বোধহয় আমার চমকে ওঠাটা খেয়াল করেনি৷ সে বলে যেতে লাগল, ‘‘পরের দিন সকালে উঠে দেখি মাথা টিপটিপ করছে৷ কিন্তু সেদিনই আমার সদিয়া ফেরার কথা৷ তাই জোর করেই স্নান করলাম৷ আয়নার সামনে বসে ফের সিঁদুর পরতে গেছি, এমন সময় আবার সেই ডাক৷ এবার আরও জোরে৷ একজন নয়, অনেকজন মিলে৷ ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর নখ দিয়ে আঁচড় কাটলে যেমন একটা অসহ্য শব্দ হয়, ঠিক সেরকম সুরে কারা যেন চিৎকার করে আমাকে বলছে, ‘ও সিঁদুর পরিসনি মেয়ে, ও সিঁদুর সর্বনেশে, অলুক্ষুণে’৷’’
‘‘আর ইউ শিওর?’’ আমার গলাটা একটু কেঁপে গেল নাকি?
‘‘একদম দাদা৷ ভুল হওয়ার কোনো জো-ই নেই৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা ব্যাপার ঘটল৷ আমার মনে হল ডান হাতের আঙুলগুলো যেন অসাড় হয়ে এসেছে, বুঝলেন? মানে মনে হল অনেক চেষ্টা করেও আমি কবজি থেকে বাকিটা আর নাড়াতে পারছি না, কে বা কেউ যেন আমার হাতটা সজোরে টেনে ধরে রেখেছে৷ ব্যাপারটা ভাবুন একটু৷ ভরা দুপুর, চারিদিকে রোদে ঝলমল, পাশের ঘরে মা রান্না করছেন, বাইরে বাবা কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন৷ আর এসবের মাঝখানে আমি আমার ড্রেসিং টেবিলের সামনে একদম স্থির বসে৷ একদম নড়তে পারছি না, চিৎকার করতে পারছি না, কানে কোনো শব্দ আসছে না, এমনকি নিঃশ্বাসও নিতে পারছি না৷ আমার মনে হচ্ছে যেন আমার চারিপাশের সবকিছু একদম স্থির হয়ে গেছে৷ দেওয়ালে টাঙানো ফটোর মতো৷’’
একটানে এতটা বলে হাঁপাতে লাগল মাধুরী৷ আমি উঠে গিয়ে একগ্লাস জল এগিয়ে দিলাম ওর দিকে৷ খেয়াল করলাম আমার নিজের হাতও অল্পস্বল্প কাঁপছে৷
‘‘তারপর?’’
‘‘ওইভাবেই ছিলাম বেশ কিছু মুহূর্ত৷ তারপর কিছুক্ষণ পর মনে হল হাতে যেন একটু সাড় পাচ্ছি৷ তখন অনেকখানি মনের জোর একসঙ্গে করে সিঁদুরটা পরে নিয়ে টলতে টলতে উঠে এলাম ওখান থেকে৷ আয়নার সামনে আর এক মুহূর্ত বসে থাকতে আমার ভয় করছিল, ভীষণ ভয় করছিল৷’’
এবার এক গ্লাস জল আমি খেলাম৷ গলাটা শুকিয়ে আসছিল আমার৷
‘‘তারপর বাকিটা বোধহয় আমি জানি৷ খেয়েদেয়ে ওঠার পর তোমার খুব জ্বর আসে, তাই না?’’
উত্তেজিত হয়ে উঠছিল মাধুরী৷ এই প্রথম লক্ষ করলাম যে উত্তেজিত হলে ওর কপাল আর গাল লাল হয়ে ওঠে, নাকের পাটা ফুলে যায়৷ আশ্বিনের ঠান্ডাতেও হিরের কুচির মতো অল্প অল্প ঘাম জমছিল ওর কপালে৷
‘‘দাঁতে কুটোটি কেটেছি কি কাটিনি, ধুম জ্বর এল আমার৷ মনে হল আমাকে কে যেন একগলা বরফঠান্ডা জলে চুবিয়ে রেখেছে৷ খাওয়ার টেবিল থেকেই ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি৷ তারপর আমার আর কিছু মনে নেই৷’’
আরামকেদারায় মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলাম একবার৷ তারপর চোখ খুলতেই ক্ষণিকের জন্য মনে হল একবার যেন দেখলাম যে মেয়েটার মাথার সিঁথিটা ফাঁকা, হাতে কোনো সধবার চিহ্ন নেই, আর যে শাড়িটা পরে আছে সেটার রং সাদা!
আবার চোখ বন্ধ করলাম৷ সারাদিনের মানসিক পরিশ্রমের পর বোধহয় আমার স্নায়ু বোধহয় এবার জবাব দিতে শুরু করেছে৷ নইলে এরকম ভুলভাল দৃশ্য দেখব কেন?
ঠিক তখনই ফের সেই গন্ধটা নাকে এল৷ ভিজে কাঠ পোড়ার ভ্যাপসা শ্বাসরুদ্ধকর গন্ধটা৷
মাধুরীকে ভিতরে বসতে বলে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম৷ আমার চোখের সামনে তখন দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকার রাত্রি৷ মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ, সামান্য মেঘ জমেছে ঈশান কোণে৷ কাকুর বাড়ির সামনের কুয়োতলাটা পেরোলেই একটা ছোট বাগান৷ সেখান থেকে শিউলির মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল৷ বাড়ির সীমানা ঘেঁষে সুপুরিগাছের সারি৷ এখানকার লোকজন খুব পান খায় দেখেছি, আর সঙ্গে কাঁচা সুপুরি৷ একবার সে জিনিস শখ করে খেতে গিয়ে প্রায় উলটে পড়ে যাচ্ছিলাম, বাবা রে! সে কী সাংঘাতিক জিনিস! এরা খায় কী করে?
এসব আবোলতাবোল ভাবছি, এমন সময় আনমনে কুয়োতলার দিকে তাকাতেই আমার মনে হল সামনের কুয়োতলা দিয়ে স্যাঁৎ করে কে একটা যেন বাড়ির ভেতরে চলে গেল৷ শুধুমাত্র সাদা কাপড়টা নজরে এল আমার, আর খানিকটা উড়ন্ত চুল৷ আমি ‘কে, কে ওখানে’ করে চেঁচিয়ে উঠলাম৷
আমার ডাক শুনে মাধুরী বাইরে বেরিয়ে এল৷ প্রশ্ন করল, ‘‘কোথায় কে?’’
‘‘ওই যে’’, বলে আমি কুয়োতলার দিকে আঙুল দেখালাম, ‘‘মনে হল ওখান দিয়ে কে যেন বাড়ির ভিতরে চলে গেল৷’’
ইতিমধ্যে কাকু আর কাকিমাও বেরিয়ে এসেছিলেন৷ দুজন কাজের লোক ভেতরে ব্যস্ত ছিল৷ তারাও কাজ ছেড়ে বেরিয়ে এল৷ আমার কথা শুনে বাড়ির আনাচকানাচ তন্নতন্ন করে খোঁজা হল৷ কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না৷