দীপাঞ্জন বিস্মিত গলায় বলল, ‘কে? কার কথা বলছ?
দরজা খুইল্যে ঢুকল কে? একবার দেখলাম মনে হইল, আর দেখতে পেলমনি!
এবার উঠতেই হয়। রাতবিরেতে বাংলোতে দরজা খুলে চোর ডাকাত ঢুকলে সেটা মোটে ভালো কথা নয়। আমরা, মানে আমি আর দীপাঞ্জন ওই আলো আঁধারিতেই বাংলোর চারিপাশ বেশ খানিকক্ষণ ধরে খুঁজলাম, কিন্তু কোথায় কে? কই কোত্থাও কেউ নেই তো!
চারিধার দেখেটেখে চাদরমুড়ি দিয়ে বসেছি, রেংতা ফের ওর গল্প শুরু করতে যাবে, এমন সময় দেখি গায়ের চাদর খুলে সোজা হয়ে উঠে বসেছে মহুয়া, চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে ওর, ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে আঙুল তুলে বলে উঠল, ওই যে, লোকটা!
ওর আঙুল সোজা সেই দোলনাটার দিকে তোলা।
এবার আমরা বাকি তিনজনেও ওদিকে ঘাড় ঘোরালাম।
দেখলাম ওই আলোআঁধারিতে দোলনাটা অল্প অল্প দুলছে, আর তাতে বসে আছে অন্ধকার রঙের একটা লোক!
কতক্ষণ নির্নিমেষে তাকিয়ে ছিলাম জানি না, হাতেপায়ে কোনও সাড় ছিল না। আমার মনে হচ্ছিলো আশেপাশে যেন আর কোনও শব্দ নেই, কোনও আলো নেই, এই বিশ্বচরাচরে আর কোত্থাও কিচ্ছুটি নেই। হাওয়া থেমে গেছে, দোলনার সেই ক্যাঁচকোঁচ শব্দ ছাড়া চারিদিকে বধির করে দেওয়ার মতো স্তব্ধতা। একটা মেঘ এসে চাঁদটাকে একবার ঢেকে দিয়ে ফের সরে যেতেই স্পষ্ট দেখলাম যে, সেই লোকটার অবয়ব যেন আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। আর যেন কতকাল ধরেই সে মানুষটা দোলনায় দুলছে, দুলেই চলেছে। আধো অন্ধকারেও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার রোগা শরীরটা।
সেই বধির স্তব্ধতা ছাড়িয়ে, সব ছাপিয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠছে ওর বুকের বাঁদিকে সেই কাটা দাগটা!
আর বুকে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে সেই আগুনে চোখ দুটো। অন্ধকারের লোকটা তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
ভুল হলো, আমাদের দিকে নয়, সে তাকিয়ে আছে শুধু মহুয়ার দিকে।
এই প্রথম ভয় পেলাম আমরা, তীব্র ভয়। মহুয়া ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, আমারও হাত-পা সরছে না ভয়ে। রেংতা কী করছে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু শুনতে পাচ্ছি দুর্বোধ্য সাঁওতালি ভাষায় কীসব বলে চলেছে সে। একেকটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে যেন এক এক যুগ। লোকটা কিছু বলছে না, কিছু করছেও না। শুধু সেই শয়তানি হাসিটা সারা মুখে মেখে গনগনে কয়লার মতো লাল চোখ মেলে এই দিকে তাকিয়ে আছে।
এমন সময় উঠে দাঁড়াল দীপাঞ্জন, সজোরে চেঁচিয়ে উঠল, কে তুই? এখানে এলি কী করে? তোর সাহস তো কম নয়। যা, যা বলছি এখান থেকে! বলে ছেড়ে রাখা চপ্পলের একটা পাটি তুলে ধরল ছুঁড়ে মারবে বলে।
আর তারপরেই ঘটল ম্যাজিক। হঠাৎ যেন লোকটার সারা দেহ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়ে সেই আধো আঁধারির মধ্যে মিশে গেল। ঘটনাটা এত চকিতে ঘটল, যে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব কিছু ফের আগের মতো! যেন একটু আগে কিছুই ঘটেনি এখানে!
মহুয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি দেওয়ালের গায়ে ঢলে পড়েছে ও। দৌড়ে গিয়ে তুলতে যাব, গায়ে হাত ঠেকাতেই দেখি তীব্র জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ওর গা।
আর ওর সারা দেহ জুড়ে একটা বিচ্ছিরি গন্ধ!
আমাদের প্ল্যান ছিল পরের দিনই যেভাবে হোক মহুয়াকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার। এখানে থাকলে এই জ্বর বেড়ে বেড়ে ও যে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে সেটা অনুমান করতে জ্যোতিষী হতে হয় না। আমি আর দীপাঞ্জন চাইছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ভূতুড়ে জায়গা ছেড়ে কলকাতা ফিরে যেতে।
কিন্তু সে প্ল্যানে বাধ সাধলেন প্রকৃতি স্বয়ং!
সেইদিন মধ্যরাত থেকে নামল আকাশপাতাল ভাসানো মুষলধার বৃষ্টি। বাপ রে, এত বছর বয়েস হয়ে গেল, সেই রাতের ঘোর বৃষ্টির কথা ভুলব না। মনে হচ্ছিল পুরো অযোধ্যা পাহাড়টা যেন গলে গলে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। সেইসঙ্গে ঠা-ঠা করে পড়ছে বাজ আর বাইরে বইছে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া। মাঝরাতে উঠে একবার জানালাটা খুলেছিলুম, দেখলাম যে বারান্দার ওপারে কে যেন একটা মোটা পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছে, এমনই অবিশ্রান্ত সেই জলধারা। মনে হচ্ছিল বাংলোর ছাদে কেউ যেন পুরো পাঞ্চেৎ ড্যামটাই খুলে উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে। নেহাত ব্রিটিশ আমলে বানানো বাংলো, নইলে সেইরাতে আমাদের ভেসে যাওয়াও কিছু বিচিত্র ছিল না।
তবে বৃষ্টি নয়, আমাকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল মহুয়ার শারীরিক অবস্থা। প্রচণ্ড জ্বর আর অসম্ভব পেট ব্যাথায় মেয়েটা তখন কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে। মাঝরাতে উঠে আরেকবার ক্যালপল দিয়েছি। তাতে সাময়িকভাবে জ্বর কমলেও পেট ব্যথার কোনও সুরাহা হওয়ার চিহ্নমাত্র নেই। ঘুমোতেও পারছে না মেয়েটা। খানিকক্ষণ ঘুমোবার পরেই অস্ফুটে—ওই, ওই এল, ওই এল আমাদের ধরবে বলে রে। ওই এল রে সাদাদের সেপাই.. এইরকম অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে সে, আর উঠে বসে উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক চাইছে। এসব দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে যে টেনশনে এবার আমিই অসুস্থ হয়ে পড়ব। এই অজানা অচেনা জায়গায় কিছু একটা হয়ে গেলে বিশ্বনাথ কাকুর কাছে গিয়ে মুখ দেখাব কী করে? এসব পাগল করে দেওয়া চিন্তায় আমার মাথাটা কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। তার ওপরে সেই বিচ্ছিরি মড়াপচা গন্ধে আমার তখন পেটের ভাত উঠে আসার জোগাড়। দীপাঞ্জনও সেদিন আমাদের ঘরেই ছিল, দিদিকে ছেড়ে একফোঁটাও এদিক-ওদিক নড়েনি ছেলেটা, ঠায় বসেছিল দরজার কাছে।