আমার কেন জানি খেতে ইচ্ছে হল না। তোরা তো জানিস, হাইজিনের ব্যাপারে আমি একটু বেশি পিটপিটে। যেখানে সেখানে ইয়ে ইয়ে হাতে বানানো খাবার খাওয়া আমার পোষায় না।
দীপাঞ্জনও ‘এখন খেলে আর খেতে পারব না।’ বলে দাঁড়িয়ে রইল। মহুয়া অবশ্য যেভাবে বুভুক্ষুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল তাতে মনে হওয়া খুবই সম্ভব যে মেয়েটা এখুনি আফ্রিকার কোনও দুর্ভিক্ষপীড়িত জায়গা থেকে এসেছে, আর ওর সামনে এখন একহাঁড়ি বিরিয়ানি।
আমার কেমন জানি একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। তোরা তো জানিস, আমার সিক্সথ সেন্স জিনিসটা খুবই প্রবল। শুধুই মনে হচ্ছিল কিছু একটা যেন ঠিক হচ্ছে না। কী যেন একটা মস্ত ভুল হতে চলেছে। অথচ তার কারণটা কিছুতেই ধরতে পারছি না। এমন সময় চোখ গেল ঘুগনিওয়ালার দিকে। আর অস্বস্তিটা চতুর্গুণ বেড়ে গেল।
অথচ লোকটাকে দেখে এমন আলাদা কিছু লাগার কথাই নয়। এই এলাকার গরিব মানুষজন যেমন হয় তেমনই। রোগাসোগা শরীর, সারা গায়ে একটা ময়লা চাদর জড়ানো, সেটাই মাথা থেকে কপাল অবধি ঢেকে রেখেছে। লোকটার চোখ নামানোই ছিল, মহুয়ার কথা শুনে শিরাওঠা হাতে বাঁ-হাতে একটা শালপাতার ডোঙা নিয়ে, ডানহাতে ধরা বড় চামচ দিয়ে ডালার ওপরে রাখা মস্ত অ্যালুমিনিয়ামের থালা থেকে ঘুগনি নিয়ে বেড়ে দিয়ে লাগল। কোনও কারণ ছিল না, তবুও আমি বেশ মন দিয়ে লোকটা লক্ষ্য করতে লাগলাম।
আমি মহুয়ার থেকে একটু কোনাকুনি দাঁড়িয়েছিলাম, লোকটার মুখের বাঁদিক আর বাঁদিকের চাদরটা সরে গিয়ে সেদিকের কাঁধটা আমার চোখের সামনে দেখা যাচ্ছিল। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল যে এই কাঁধটা আমি দেখেছি, এবং শুধু তাই নয়, খুব সম্প্রতি দেখেছি। কিন্তু কোথায় দেখেছি সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না।
লোকটা ঘুগনিটা দিল, চামচটা রাখল থালার কিনার ঘেঁষে। তারপর ডালার একটু নীচ থেকে একটা ময়লা পুঁটুলি বার করল। আমি তখনও দেখে যাচ্ছি। পুঁটুলি মধ্যে থেকে কী একটা বার করে, খুব সম্ভবত বিটনুন হবে, ঘুগনির ওপর ছড়িয়ে দিল। তারপর একটা শালপাতার টুকরো চামচ হিসেবে ঘুগনিটার মধ্যে গুঁজে দিয়ে সেটা বাড়িয়ে দিল মহুয়ার দিকে।
পুঁটুলিটা দেখেই আমার ঘেন্না লাগছিল খুব। কিন্তু মহুয়াকে এসব বলে খুব একটা লাভ নেই। সে ততক্ষণে একসঙ্গে অনেকটা ঘুগনি মুখে তুলে পরম তৃপ্তির সঙ্গে চিবোতে চিবোতে আমাকে বলল, কীরে দীপু, একচামচ খাবি নাকি? আমি যথারীতি ঘাড় নেড়ে না বলে ব্যাগ থেকে দু’টাকা বার করে লোকটার সামনে এসে তার হাতে দিতে গিয়ে দেখি লোকটা এইবার চোখ তুলে তাকিয়েছে, আর সটান তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকেই।
সেই দৃষ্টি দেখে আমার বুকের ভেতরটা একবার ধ্বক করে উঠল, জানিস! সেই চোখ দুটোর কোণায় এমন একটা শয়তানি হাসি যেটা দেখলে অতি বড় সাহসীরও বুক কেঁপে উঠতে বাধ্য। আমি চট করে টাকা দুটো প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে মহুয়ার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসছি, এমন সময় সেই বিটনুনের পুঁটুলিটা থেকে খানিকটা বিটনুন উড়ে এসে আমার হাতে এসে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে সেই নুনটা ঝেড়ে ফেলতে যাচ্ছি, দেখি নুনের দানাগুলো আমার হাতে লেপ্টে গেল।
আর তখনই বুঝলাম যে এটা নুন নয়।
এটা ছাই।
এই ছাই কয়েকদিন আগেই আমরা দেখেছি একবার।
কলেজ স্ট্রিট থেকে শেয়ালদা যাওয়ার সময় যে লোকটার টানা রিকশায় গেছিলাম, তার গা থেকে এইরকম ছাই উড়ে আসছিল।
তার চোখটাও এরকম ছিল, তার কাঁধটাও এরকম। তাই আমার অত চেনা চেনা লাগছিল।
এই লোকটা সেই লোকটা।
বিদ্যুৎচমকের মতো কথাগুলো একের পর এক মাথার মধ্যে গেঁথে যেতেই আমার গা’টা ভয়ে শিরশির করে উঠল। আর ঠিক সেই সময়ে হু-হু করে হাড়ে কাঁপুনি ধরানো একটা প্রবল হাওয়ার স্রোত যেন কোথা থেকে ছুটে এসে আমাদের ঘিরে ধরে নাচতে লাগল, আর কে যেন হা হা করে হেসে উঠে বলল, ‘কালিয়া মাসান, কালিয়া মাসান।’
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম লোকটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে জায়গাটা খালি, যেন কেউ ওখানে কখনও ছিলই না।
মহুয়া আর দীপাঞ্জনকে নিয়ে আমি ছুট লাগালাম মংলাদা’র টেম্পোর দিকে। ঝটপট করে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ‘বাংলোয় চলো মংলাদা। এক্ষুনি।’
আর সেই রাতেই জ্বর এল মহুয়ার। বেহুঁশ করে দেওয়া প্রবল জ্বর।’
এতক্ষণ কথা বলে দীপুপিসির গলা শুকিয়ে গেছিল। স্যান্ডির দিকে তাকাতেই স্যান্ডি একটা পান আর জলের বোতল পিসির দিকে এগিয়ে দিল, আর ওর দিকে তাকিয়ে একটা মধুর স্নেহের হাসি উপহার দিয়ে পিসি ফের শুরু করলেন।
‘সেই রাতটার কথা আমার খুব মনে থাকবে রে। অমন বিপদে জীবনে কখনও পড়িনি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আর যেন কোনওদিন পড়তেও না হয়।
টেম্পোতে বসেই কেমন যেন চুপ করে গেছিল মহুয়া, কোনও কথা বলছিল না। দীপাঞ্জনও একটু ঘাবড়ে গেছিল। আমি গাড়িতে যেতে যেতে একবার ঠেলা দিলাম মহুয়াকে, বললাম কী রে মৌ, চুপ করে গেলি যে। কিছু বলল না মেয়েটা, শুধু একবার অদ্ভুতচোখে আমার দিকে তাকাল।
খেয়াল করলাম চোখটা লাল হয়ে আছে একটু।
বাংলোতে পৌঁছে মংলাদাকে ছেড়ে দিলাম। বললাম পরেরদিন সকালে আসতে, ইচ্ছা ছিল পরের দিন জঙ্গলের একটু ভেতরের দিকে যাব। মংলাদা টেম্পো ঘুরিয়ে চলে যেতেই অন্ধকারটা ঘিরে ধরল আমাদের। মেন গেট থেকে বারান্দা অবধি মোরাম বিছানো রাস্তা, আমরা হেঁটে হেঁটে গেট যাচ্ছি, এমন সময় মহুয়া হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা তো অবাক, জিগ্যেস করলাম, কী রে, কী হল?