বাথরুমে যাওয়ার নাম করে অজয় বাইরে গিয়ে নিজের চশমাটা পকেটে পুরে তার বদলে ভুরু-চশমা-নাক-মোচের এই অদ্ভুত মুখোশটি পরে নিয়েছে৷ তারপর কেউকেটা এক অচেনা আগন্তুক সেজে হরিনাথ স্যারের ক্লাসে ফিরে এসেছে৷
হরিনাথবাবু একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে অজয়কে লক্ষ্য করে লাফ দিলেন৷ এবং দরজার প্রায় কাছাকাছি গিয়ে ল্যান্ড করলেন৷ একইসঙ্গে স্যারের মুখ দিয়ে দুটো গালাগাল বেরিয়ে এল৷ প্রথম গালাগালটা খুবই সাধারণ মানের৷ একটি মাত্র শব্দে তৈরি৷ দু-অক্ষরের শব্দ—যার শেষ অক্ষরটি ‘লা’৷
আর দ্বিতীয় গালাগালটি কিঞ্চিৎ উন্নত মানের৷ দুটি শব্দে তৈরি—যার সাহায্যে কোনও ব্যক্তিকে একটি বিশেষ পশুর সন্তান হিসেবে সম্বোধন করা হয়৷
হরিনাথ স্যারের মুখে আচমকা এইরকম একজোড়া অশিষ্ট সম্বোধন শুনে আমরা যেমন আঁতকে উঠেছি, তেমনই—অন্যায়ভাবে—অদ্ভুত একটু মজাও পেয়েছি৷
কিন্তু স্যার ওকে ধরে ফেলার আগেই অজয় দে ছুট৷ আর কী আশ্চর্য, স্যারও ওকে তাড়া করলেন!
ক্লাসরুমের করিডরের দিকের জানলা দিয়ে আমরা কেউ-কেউ বডি অর্ধেক ঝুঁকিয়ে দিয়ে সেই রেস দেখতে লাগলাম৷ আর বাকিরা ভিড় জমাল ক্লাসরুমের দরজায়৷
সে এক অদ্ভুত দৃশ্য!
স্কুলের লম্বা-চওড়া করিডর ধরে অজয় তিরবেগে দৌড়চ্ছে৷ আর ওর বেশ খানিকটা পেছনে ছুটে চলেছে ‘ককরোচ’ স্যার৷
একটা ভারী খাতা হাতে উলটোদিক থেকে হেঁটে আসছিল তৃপ্তিদা—আমাদের স্কুলের পিওন৷ তৃপ্তিদা একটু দুলে-দুলে হাঁটত৷ তাই আমরা ওর নাম দিয়েছিলাম ‘দোলনা’৷
স্যার বোধহয় ছুটে-ছুটে হাঁপিয়ে পড়েছিলেন৷ তাই তৃপ্তিদাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ অজয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘অ্যাই তৃপ্তি,কে এক্ষুনি হেডস্যারের কাছে নিয়ে যা—৷’
চার অক্ষরের এই তৃতীয় গালাগালটি দ্বিতীয়টির তুলনায় আরও কিছুটা উন্নত মানের৷ এবং একইসঙ্গে বেশ ধাক্কা দেওয়ার মতো৷ আমরা তো সে-ধাক্কা খেয়েই ছিলাম, দেখলাম তৃপ্তিদাও ধাক্কা খেয়ে করিডরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে৷
না, অজয়কে ধরা যায়নি৷ ও ততক্ষণে পগার পার৷ হয়তো ছুটে পালিয়ে গিয়ে বারান্দার পাশের কোনও গাছ বেয়ে নীচের উঠোনে নেমে গেছে৷
এই ঘটনার দু-চারদিন পর থেকে হরিনাথ স্যারকে স্কুলে আর দেখিনি৷ কানাঘুষোয় শুনেছিলাম, স্কুলের মধ্যে অশিষ্ট শব্দ ব্যবহারের জন্যে ওঁকে স্কুল ছাড়তে হয়েছে৷
এ-ঘটনায় অজয়েরও মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল৷ কারণ, ও স্যারের সঙ্গে নিছকই একটু মজা করতে চেয়েছিল৷ তার ফল যে এমনটা হবে সেটা ও ভাবতে পারেনি৷
ক্লাস এইটের পর অজয়ের সঙ্গে আর পড়ার সুযোগ পাইনি৷ কারণ, ক্লাস নাইন থেকে ছাত্রদের চারটি শাখায় ভাগ করা হত—সায়েন্স, টেকনিক্যাল, আর্টস ও কমার্স৷ আমি সায়েন্স নিয়ে পড়েছিলাম, অজয় নিশ্চয়ই অন্য কোনও শাখায় পড়াশোনা করেছিল৷ ফলে আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি৷
কথাটা ভুল বলা হল৷ আমার বলা উচিত, আমি ওকে দেখতে পাইনি৷ কারণ, অজয় আমাদের কাউকেই সেভাবে চিনত না, কিন্তু আমরা সব্বাই ওকে চিনতাম৷ আর আমি বোধহয় মনে-মনে একটু-একটু অজয় হতে চাইতাম৷
স্কুলের পালা শেষ হল আমার৷ হয়তো অজয়েরও৷ তারপর সময়ের স্রোতে পেরিয়ে গেল প্রায় পঞ্চাশ বছর৷ আমি অজয়কে ভুলিনি৷ ভুলিনি ‘দাদুভাই স্টোর্স’ দোকানটিকেও৷ কিন্তু কাজের জগৎ আমাকে কলকাতার অন্যান্য অঞ্চলে এমন ব্যস্ত করে তুলল যে, ‘দাদুভাই স্টোর্স’-এর রাস্তায় কখনও যাওয়া হয়নি৷ যদি বা কখনও গিয়ে থাকি, আমার মন তখন এতই ব্যস্ত ছিল যে, দোকানটা খেয়াল করিনি৷
কিন্তু গতকাল সন্ধেবেলা একটা ব্যাপার হল৷ বাড়ির একটা জরুরি কাজে একজন ল’ইয়ারের চেম্বারে গিয়েছিলাম৷ কথাবার্তা শেষ করে বিধান সরণির ট্রামরাস্তার ধারে বাস ধরব বলে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎই চোখ গেল উলটোদিকের ফুটপাথের একটা ছোট্ট দোকানের দিকে৷ জীর্ণ, মলিন চেহারা৷ তোবড়ানো সাইনবোর্ড৷ দোকানের নামের কয়েকটা অক্ষর মুছে গেলেও ‘ভাই’ এবং ‘স্টো’ অংশ দুটো পড়া যাচ্ছে৷ অজয়দের দোকান!
আমার পা দুটো সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তা পার হয়ে গেল৷ আমার দ্বিধা-সঙ্কোচকে পাত্তা না দিয়ে ওরা সটান গিয়ে হাজির হয়ে গেল অজয়ের দোকানের সামনে৷
কিন্তু কোথায় অজয়?
দোকানে বসে আছে আঠেরো-উনিশ বছরের একটি ছেলে৷ রোগা৷ মাজা রং৷ সবে দাড়ি-গোঁফ উঠেছে৷ চোখ দুটো বড়-বড়—যাকে পরিভাষায় আয়ত বলে৷ মাথার চুল খাড়া-খাড়া৷ গায়ে একটা চেক-চেক হাওয়াই শার্ট৷ পায়ে পাজামা৷
দোকানের শো-কেস ময়লা৷ কাচ দু-তিন জায়গায় ফাটা৷ সেইসব ফাটল পিভিসি টেপ দিয়ে তাপ্পি মারা৷
দোকানের শো-কেসের ভেতরে হরেকরকম বলপয়েন্ট পেন, পেনসিল আর রিফিল৷ দু-পাশের তাকে লাট করে রাখা খাতা আর দিস্তে কাগজ৷ দোকানের ডানদিকে সুতোয় বাঁধা অনেকগুলো প্লাস্টিকের বল আর খেলনাপাতি ঝুলছে৷ বোঝাই যাচ্ছে, খাতা, পেন, পেনসিলের পাশাপাশি বাচ্চাদের টুকিটাকি খেলনাও ‘দাদুভাই স্টোর্স’ বিক্রি করে থাকে৷
বাঁ-দিকের তাকগুলোর মাঝে একটা ছোট্ট খাঁজে ঠাকুরের আসন চোখে পড়ল৷ সেখানে খুব সরু-সরু কালো রঙের ধূপকাঠি জ্বলছে৷
দোকানে দাঁড়ানো ছেলেটিকে ভালো করে দেখলাম৷
না, আমার স্মৃতিতে অমলিন অজয়ের মুখের আদলের সঙ্গে ছেলেটির মুখের আদল কিছুতেই মিলছে না৷