আমি হাতিবাগান থেকে রোজ স্কুলে যাতায়াত করতাম—ওই কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে৷ যাতায়াতের পথে ট্রাম কিংবা বাস থেকে গলা বাড়িয়ে অজয়দের দোকানটাকে খুঁজতাম৷
দেখতে-দেখতে একদিন খুঁজেও পেলাম৷ ছোট্ট মলিন দোকান৷ রংচটা সাইনবোর্ড৷ দোকানে ধুতি আর ফতুয়া পরে একজন রোগামতন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন৷ গাল বসা, মাথায় টাক৷ খোঁচা-খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফ৷ অজয়ের বাবা৷
দোকানটাকে খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই স্কুলে যাতায়াতের পথে আমার চোখ আমার অজান্তে ‘দাদুভাই স্টোর্স’-কে খুঁজে বেড়াত৷ এবং পেয়েও যেত৷
ক্লাস এইটে ওঠার পরেও অজয়ের সঙ্গে একই সেকশানে পড়ার ‘সৌভাগ্য’ আমার হয়েছিল৷ সেই ক্লাসে অজয় এমন এক কীর্তি ঘটিয়ে বসেছিল যেটা আমি আজও ভুলতে পারিনি৷
ব্যাপারটা হয়েছিল হরিনাথবাবুর ক্লাসে৷
এখানে হরিনাথবাবু সম্পর্কে দু-চারটে কথা বলা দরকার৷
তিনি আমাদের অ্যাডিশন্যাল ইংলিশ পড়াতেন৷ অর্থাৎ, প্রথাগত ইংরেজি ক্লাসে যে-টেক্সট বই বা গ্রামার পড়ানো হত, ওঁর পড়ানোর এলাকা ছিল তার বাইরে৷ ফলে হরিনাথবাবুর ক্লাসে আমরা নতুন-নতুন ইংরেজি শব্দ আর সেসব শব্দ দিয়ে মজার-মজার বাক্যরচনা, কিংবা শব্দের জাগলারি শিখতাম৷
যেমন, তিনি ক্লাসে প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, ‘বল—, How can you make a mile smile?’
আমরা উত্তর না দিয়ে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম৷
পাঁচ কি দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর স্যার হেসে বলতেন, ‘এই সহজ প্রশ্নটার উত্তর কেউ দিতে পারলি না? The letter ”s” makes a mile smile, বুঝলি?’
হরিনাথবাবু মাঝবয়েসি মানুষ৷ চোখে গোল-গোল কাচের চশমা৷ মাথায় কদমছাঁট চুল৷ উচ্চতায় খুব খাটো ছিলেন৷ সবসময় ধুতি আর পাঞ্জাবি পরতেন৷ আর হাঁটতেন আরশোলার মতো তাড়াতাড়ি৷ স্কুলের লম্বা বারান্দা ধরে ওঁর হেঁটে যাওয়া দেখলে আমরা হাসি চেপে রাখতে পারতাম না৷ শুধুমাত্র হাঁটার ঢঙের জন্যেই আমরা স্যারের গোপন ডাকনাম রেখেছিলাম ‘ককরোচ’৷
হরিনাথবাবুর মধ্যে একটা কমিক-কমিক ব্যাপার ছিল৷ তা ছাড়া ওঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে নানান তর্ক-বিতর্ক চলত৷ এর কারণ ছিল আমাদের বাৎসরিক স্কুল ম্যাগাজিন৷
আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে হেডস্যার থেকে শুরু করে সব টিচারের নাম ছাপা হত৷ আর সেই নামের পাশে-পাশে ছাপা হত স্যারদের সব অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি৷ সেই ম্যাগাজিনেই আমরা দেখেছিলাম, আমাদের অঙ্ক স্যারের এম. এ. ডিগ্রি—যা বহুকাল হল দেখা যায় না৷ আমাদের বাংলা স্যার পীতাম্বরবাবুর নামের পাশে ডবল এম. এ. ডিগ্রি ছিল—একটা বাংলায়, আর অন্যটা সংস্কৃতে৷ সেই ডবল এম. এ. ডিগ্রিও অনেক বছর হল উধাও৷
তো নানান স্যারের নানান ডিগ্রির মধ্যে হরিনাথবাবুর নামটা আমাদের চোখে কটকট করত, কারণ স্যারের নামের পাশে কোনও ডিগ্রিই লেখা থাকত না৷ ব্যাপারটা আমাদের ভারী অদ্ভুত লাগত৷ তাই স্যার আসলে যে ঠিক কী পাশ, কতটুকু পাশ, এসব নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম৷ এসব আলোচনা যে অশোভন এবং অন্যায় সেটা ওই ছোট বয়েসে আমরা বুঝতে পারিনি৷ তবে স্কুল কর্তৃপক্ষও স্কুল ম্যাগাজিনে স্যারদের নামের পাশে-পাশে তাঁদের অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি ছাপার প্রথাটা না রাখলেই পারতেন৷ ছাত্রদের কাছে স্যারদের শুধু নামই কি যথেষ্ট নয়!
সে যা-ই হোক, হরিনাথবাবু একদিন অজয়ের দুষ্টুমির শিকার হলেন৷
স্যার ক্লাসে হাসি-হাসি মুখ করে আমাদের ইংরেজি শেখাচ্ছিলেন—অ্যাডিশনাল ইংলিশ৷ যেটাকে আমরা কখনও-কখনও বলতাম ‘বাড়তি’ ইংরেজি৷
যেমন, স্যার প্রশ্ন করতেন, How a lot goes through a slot?
আমরা উত্তর দিতে পারি বা না পারি, স্যার একটু পরেই হেসে বলতেন, ‘The letter ”s” makes a lot go through a slot,’—বুঝলি?’
এরকমই আর-একটা প্রশ্ন ছিল, ‘What makes a road broad?’
এভাবেই আমরা হরিনাথবাবুর কাছে ‘বাড়তি’ ইংরেজি শিখতাম৷
একদিন ক্লাস চলার সময় অজয় হাত তুলে স্যারের কাছে বাথরুমে যাওয়ার পারমিশান চাইল৷
কোনও স্যারের ক্লাসের মাঝে অজয় বাথরুমে যাওয়ার পারমিশান চাইলেই আমরা নতুন কোনও দুষ্টুমি দেখার প্রত্যাশায় থাকতাম৷
হরিনাথবাবু অজয়কে জিগ্যেস করলেন, ‘বিগ অর স্মল?’
অজয় বলল, ‘লিকুইড, স্যার—৷’
অজয়ের মুখে ‘লিকুইড’ শুনে আমরা সবাই তো হেসে খুন৷ কিন্তু হরিনাথবাবু কী এক আশ্চর্য ক্ষমতায় নিজের গাম্ভীর্য ধরে রাখলেন৷ তিনি তাড়াতাড়ি অজয়কে অনুমতি দিয়ে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করলেন৷
‘যা, তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি—৷’
অজয় মুখে কোনও কথা না বলে প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি ঘাড় হেলিয়ে দিল এবং চটপট পা চালিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল৷
কিন্তু ও ফিরে এল এক মিনিটের মধ্যেই৷
‘মে আই কাম ইন, স্যার?’
গলাটা অজয়ের, কিন্তু মানুষটা কে?
মোটা লোমশ ভুরু৷ চোখে এক অদ্ভুত চশমা৷ চশমার দুটো সার্কেলের মাঝে বিশাল মাপের খাড়া গোলাপি নাক৷ সেই নাকের নীচে পাকানো মোচ৷
কে এই লোকটা?
আসলে ব্যাপারটা হল, সেই সময়ে প্লাস্টিকের এই খেলনাটা কিনতে পাওয়া যেত৷ ভুরু, চশমা, নাক এবং ওই পেল্লায় মোচ একইসঙ্গে আটকানো—অনেকটা একটা মুখোশের মতো৷ তবে সেই চশমায় কাচ অথবা প্লাস্টিকের কোনও লেন্স থাকত না৷