সেদিন থেকেই অজয়কে আমি মনে-মনে ‘হিরো’ বলে মেনে নিয়েছিলাম৷
অজয় ফুটবল খেলতে ভালোবাসত—আর সেটা খেলতও বেশ৷ ওর গাঁট্টাগোঁট্টা শরীরে বয়েসের তুলনায় শক্তি অনেকটাই বেশি ছিল৷ ফুল ব্যাক পজিশানে খেলে সেই শক্তি ও দিব্যি কাজে লাগাত৷
আমাদের স্কুলের ভেতরে সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন ছিল৷ উঠোনটার চেহারা ছিল ইংরেজি ‘L’ অক্ষরের মতো৷ আমাদের টিফিনের জন্যে বরাদ্দ সময় ছিল মাত্র কুড়ি মিনিট৷ টিফিন খাওয়ার পর যেটুকু সময় হাতে থাকত সেই সময়টা আমরা অনেকেই একটা ইটের টুকরোকে ‘ফুটবল’ বানিয়ে সেই বাঁধানো উঠোনে দিব্যি ফুটবল খেলতাম৷ আমাদের পায়ে থাকত কালো রঙের চামড়ার বুটজুতো—যেটা স্কুল ড্রেসেরই অঙ্গ৷ ফলে ওই বিচিত্র ‘ফুটবল’ খেলার সময় পায়ে চোট পাওয়ার তেমন ভয় ছিল না৷
ওই ‘ফুটবল’ খেলার সময়েই আমি অজয়ের বাড়তি শক্তির ব্যাপারটা বেশ টের পেয়েছিলাম৷
অজয়কে নিয়ে দ্বিতীয় যে-ঘটনাটার কথা মনে পড়ছে সেটা হয়েছিল ইতিহাসের স্যার রমাপদবাবুর ক্লাসে৷
রমাপদবাবু ভীষণ রোগা ছিলেন৷ হাত-পাগুলো ছিল দড়ি পাকানো৷ নাকটা ঈগল পাখির মতো৷ গাল ভাঙা৷ সবসময়েই বিরক্তিতে যেন কপাল কুঁচকে আছেন৷
ওঁর চোখে চশমা ছিল৷ ধুতির খুঁট দিয়ে সেই চশমার কাচ পরিষ্কার করাটা ওঁর একরকম মুদ্রাদোষ ছিল বলা যায়৷
আমরা স্যারের ডাকনাম দিয়েছিলাম ‘কঞ্চি’৷ সেই নামটা আমরা শুধু নিজেদের মধ্যেই ব্যবহার করতাম৷
আর স্যার আমাদের সব্বাইকে একটাই নামে ডাকতেন: ‘বাঁদর৷’ শুধু মাঝে-মাঝে ওঁর পছন্দসই কোনও বিশেষণ ওই ‘বাঁদর’ শব্দটার আগে বসিয়ে দিতেন৷ যেমন, আমাদের চেহারার সাইজ দেখে রমাপদবাবু কাউকে বলতেন ‘বড় বাঁদর’, কাউকে বলতেন ‘মিডিয়াম বাঁদর’৷ আবার কাউকে বলতেন ‘ছোট বাঁদর’৷ তবে অজয়ের জন্যে স্যারের স্পেশাল ডাক ছিল ‘লঙ্কা বাঁদর’৷ এই নামের যে কী তাৎপর্য তা আমরা কখনও বুঝতে পারিনি৷
রমাপদবাবু সবসময় বলতেন, ‘শোন, প্রত্যেকটা মোমেন্টে আমাদের বয়েস বাড়ে৷ বয়েস বাড়ে, আর ইতিহাস তৈরি হয়—বুঝলি? এই যে চল্লিশ মিনিট ধরে তোরা আমার ক্লাস করলি, তোদের সবার বয়েস ফর্টি মিনিটস করে বেড়ে গেল, আর হিস্ট্রি তৈরি হয়ে গেল৷ ইতিহাস এত চুপিচুপি তৈরি হয় যে, খেয়াল না করলে টের পাওয়া যায় না৷’
এই ধরনের কথাবার্তা রমাপদবাবুর ফেভারিট ছিল৷ সুযোগ পেলেই সেগুলো একদফা করে আউড়ে নিতেন৷ সবসময়েই বোঝাতে চাইতেন যে, বিষয় হিসেবে ইতিহাস কী সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ৷
একদিন রমাপদবাবুর ক্লাস চলছিল৷ ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে ফোর্থ বেঞ্চ থেকে অজয় হাত তুলল: ‘স্যার, একটু বাইরে যাব?’
‘কেন রে, লঙ্কা বাঁদর? কী এমন জরুরি কাজ পড়ল যে বাইরে যাবি?’
উত্তরে অজয় ওর বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলটা উঁচিয়ে দেখাল: ‘ছোট বাইরে যাব, স্যার—৷’ নরম সুরে অজয়ের আবেদন শোনা গেল৷
‘যা, যা—চটপট সেরে আয়৷’
স্যারের অনুমতি পাওয়ামাত্রই অজয় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং ক্লাসরুমের দরজার দিকে চটপটে পায়ে রওনা দিয়েছে৷
ব্যাপারটা সাদামাঠা ‘ছোট বাইরে’-র কেস বলেই আমরা সবাই ধরে নিয়েছিলাম৷ কিন্তু বহু মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরেও অজয় ফিরছে না দেখে আমরা কেউ-কেউ প্রমাদ গুনলাম৷
সাধারণত ‘ছোট বাইরে’-র অপারেশানে বড়জোর তিন কি চার মিনিট লাগে৷ কিন্তু অজয় তো দেখছি প্রায় বিশ মিনিট পার করে দিয়েছে!
রমাপদবাবু পড়ানোর ফাঁকে-ফাঁকে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিলেন৷ দেখছিলেন, অজয় ফিরল কি না৷
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ক্লাসের দরজায় অজয় এসে হাজির৷
‘স্যার, আসব?’
স্যার অজয়ের দিকে তাকালেন৷ আমরাও৷
আমরা সবাই একসঙ্গে অবাক হয়ে গেলাম৷ কারণ, অজয়ের মাথা ভরতি পাকাচুল!
‘ক-কী-কী রে? তোর মাথার এ কী অবস্থা হয়েছে?’
অজয় বলল, ‘স্যার, আমার বয়েস বেড়ে গেছে৷’
আমরা সবাই হো-হো করে হেসে উঠলাম৷
স্যার আমাদের দিকে ফিরে ‘চোপ!’ বলে ধমক দিয়ে অজয়কে আবার জিগ্যেস করলেন, ‘বাথরুমে গিয়ে এতক্ষণ ধরে কী করছিলি, হতভাগা?’
‘চুপিচুপি ইতিহাস তৈরি করছিলাম, স্যার৷’ অজয়ের নিষ্পাপ উত্তর৷
এরপর যে-হাসির রোল উঠেছিল, স্যারের মালটিপল ধমকও তাকে থামাতে পারল না৷
উত্তেজিত রমাপদবাবু চেয়ার ছেড়ে তিরবেগে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন অজয়ের ওপরে৷ ওর চুলের মুঠি ধরে গালে একটা থাপ্পড় কষালেন৷
হয়তো স্যার আরও কিছু করতেন, কিন্তু তার আগেই পিরিয়ড শেষের ঘণ্টা পড়ে গেল৷ এবং অজয়ও বেঁচে গেল৷
স্যার চলে যেতেই অজয়কে আমরা অনেকে চেপে ধরেছিলাম: ‘বল, কী করে তোর চুল পাকালি?’
অজয় হেসে বলল, ‘আটা দিয়ে৷ বাড়ি থেকে খানিকটা আটা ঠোঙায় করে নিয়ে এসেছিলাম৷ বাথরুমে গিয়ে সেই আটা মাথায় বুলিয়ে নিয়েছিলাম৷ দেশের বাড়িতে দেখেছি, যাত্রাপালায় মাথায় আটা বুলিয়ে মেকাপ নিচ্ছে, চুল পাকাচ্ছে—৷’
আমরা সবাই আলোচনা করতে লাগলাম, অজয় রমাপদবাবুকে রীতিমতো ‘ঐতিহাসিক’ ধাক্কা দিয়েছে৷
বন্ধুদের কার কাছে যেন শুনেছিলাম, অজয়দের একটা ছোট্ট মনিহারি দোকান আছে—কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের (এখন যার নাম বিধান সরণি) ট্রামরাস্তার ওপরে৷ নাম ‘দাদুভাই স্টোর্স’৷ অজয়ের বাবা দোকান চালান৷ আর অজয় নাকি স্কুল ছুটির পর সন্ধেবেলা দু-ঘণ্টা করে দোকানে বসে, বাবাকে একটু বিশ্রাম দেয়৷