জানলা নিয়ে এত কথা বলার কারণ, অজয়ের কীর্তিকাহিনির প্রথম এপিসোডে জানলার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে৷
সকালবেলার প্রথম ক্লাস৷ বাংলার স্যার পীতাম্বরবাবু ক্লাসে ঢুকে গুছিয়ে বসেছেন৷ পোশাক ধপধপে ধুতি আর পাঞ্জাবি৷ রোগা, ফরসা চেহারা৷ চোখে চশমা৷
কয়েকমাস এই স্যারের ক্লাস করার অভিজ্ঞতায় আমরা সকলেই জেনে গেছি এই স্যার বেশ কড়া এবং গম্ভীর প্রকৃতির৷ তাই আমরা ওঁকে নিজেদের মধ্যে ‘ভোম্বল’ নামে ডাকি৷
শুধু তাই নয়, একদিন অঙ্কের স্যার মহাদেববাবুর পিরিয়ডে প্রক্সি দিতে পীতাম্বরবাবু এসেছিলেন৷ এসেই মাপা গলায় বলেছিলেন, ‘অ্যাই, শোনো৷ তোমাদের মধ্যে একজন এখানে এসো৷ এসে একটা গল্প বলো৷ বাকি সবাই মন দিয়ে শুনবে—কেউ কোনও গোলমাল করবে না—৷’
স্যারের কথা শেষ হওয়ামাত্রই অজয় হাত তুলে বলেছিল, ‘আমি গল্প বলব, স্যার?’
‘হ্যাঁ, চলে এসো—৷’
অজয় গম্ভীর মুখে স্যারের খাটো মঞ্চের পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ গম্ভীর গলায় স্যারকে জিগ্যেস করল, ‘স্যার, ‘‘ভোম্বল সর্দার’’ গল্পটা বলব?’’
স্যার ‘হ্যাঁ’ বলার আগেই আমরা গোটা ক্লাস হেসে কুটিপাটি৷ কিন্তু অজয় তখনও গম্ভীর মুখে স্যারের দিকে তাকিয়ে স্যারের অনুমতির অপেক্ষা করছে৷
তো যেদিনের কথা বলছিলাম৷
সকালবেলার প্রথম ক্লাসে এসে পীতাম্বরবাবু রোলকল করতে শুরু করেছেন৷ আমরা রোল নম্বর অনুযায়ী পরপর সাড়া দিচ্ছি : ‘প্রেজেন্ট, স্যার’, ‘ইয়েস স্যার’, ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ ইত্যাদি৷
অজয়ের রোল নম্বর ছিল আঠেরো৷ স্যার ‘এইটিন’ বলে ডাকার সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন উত্তর ভেসে এল, ‘প্রেজেন্ট প্লিজ৷’
অজয় যে-ডেস্কে বসত সেইদিকে তাকালেন পীতাম্বরবাবু৷
অজয়ের ডেস্ক-চেয়ার খালি৷
অবাক হয়ে স্যার আবার ডাকলেন, ‘রোল নাম্বার এইটিন—৷’
আবার উত্তর এল, ‘প্রেজেন্ট প্লিজ—৷’
কিন্তু অজয়কে দেখা যাচ্ছে না৷
আমরাও বেশ অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অজয়কে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু অজয় ক্লাসে কোথাও নেই৷
‘অজয়, তুই কোথায়? শিগগিরই বেরিয়ে আয়—৷’ বেশ উত্তেজিত হয়ে ডেকে উঠলেন পীতাম্বরবাবু৷
উত্তরে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল৷ দু-ঠোঁট মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে বাতাস টানলে যে বিচিত্র শব্দ তৈরি হয়, সেরকম শব্দ করে কেউ একটা তাল বাজানোর চেষ্টা করছে৷ স্যারের হুঙ্কারে সে-শব্দ মোটেই থামেনি৷
ততক্ষণে আমাদের অনুসন্ধানী চোখ সেই মিউজিশিয়ানকে খুঁজে পেয়েছে৷ সে আর কেউ নয়—আমাদের অজয়৷
একটা জানলার বাইরে কার্নিশে অজয় চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে৷ দু-হাঁটু ভাঁজ করা৷ মুখে ওই পিকিউলিয়ার শব্দ করছে, আর হাত দিয়ে নিজের দু-হাঁটুতে তাল ঠুকছে৷
আমরা সবাই মজা পেয়ে হেসে উঠেছিলাম, কিন্তু স্যার ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ কারণ, ওই কার্নিশ থেকে অজয় যদি অসাবধানে পড়ে যায়!
এক অদ্ভুত স্নেহমাখা গলায় পীতাম্বরবাবু ডেকে উঠেছিলেন, ‘বাবা অজয়, আয় বাবা, ক্লাসের ভেতরে চলে আয়৷ অ্যাই, তোরা কয়েকজন ওকে হেলপ কর৷ সাবধানে ধরে ওকে ক্লাসের ভেতরে নামা…৷’
আমরা কয়েকজন অজয়কে হেলপ করার জন্যে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই অজয় জানলা দিয়ে ঢুকে এল, এক লাফে নেমে পড়ল ক্লাসরুমে৷
আমরা সবাই চুপ৷ মনে একটা কী হয়, কী হয় ভাব৷ লক্ষ করলাম, পীতাম্বরবাবু এবার পালটে গেছেন৷ একটু আগের আশঙ্কা, স্নেহ এখন উধাও৷ তার বদলে তিনি ঠান্ডা চোখে অজয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ এমন ঠান্ডা সেই দৃষ্টি যে, ওঁর চোখের পাতাও পড়ছে না৷
স্যার যেন হিসহিস করে অজয়কে কাছে ডাকলেন, ‘আয়, এদিকে আয়…৷’ তারপর ফার্স্ট বেঞ্চে স্যারের কাছাকাছি বসা অশোক নামের এক সহপাঠীকে বললেন, ‘অশোক, তোর স্কেলটা দে তো৷’
অশোক বরাবরই স্যারদের প্রতি অনুগত প্রাণ৷ ও সঙ্গে-সঙ্গে নিজের স্কেল বাড়িয়ে দিল স্যারের দিকে! সে-আমলের কাঠের স্কেল—এক ফুট লম্বা৷
পীতাম্বরবাবু অস্বাভাবিকরকম রেগে গেলে তবেই শারীরিক আক্রমণের পথে যেতেন৷ এবং সেইসব আক্রমণে ওঁর বরাবরের হাতিয়ার ছিল স্কেল৷
অজয় পায়ে-পায়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেল৷ ক্লাসরুম থমথম করছে৷ কারও মুখে কোনও কথা নেই৷
‘জানলার বাইরে ওই কার্নিশে গিয়ে উঠেছিলিস কেন?’ স্যার কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে বাতাসে স্কেল নাড়ছিলেন৷
‘কার্নিশে গিয়ে তো উঠিনি, স্যার৷ জানলার বাইরে ওই যে শিমুল গাছটা রয়েছে, ওটা বেয়ে পার্কে নেমে গিয়েছিলাম…৷’
এই পর্যন্ত শোনামাত্রই বাতাসে স্কেল নাড়ার ব্যাপারটা থেমে গেল৷ দেখলাম, স্যার গোল-গোল চোখ করে অজয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ অজয় তখনও ওর অ্যাডভেঞ্চারের কৈফিয়ত দিয়ে চলেছে৷
‘পার্কে স্যার, একটা কাঠগোলাপ গাছ আছে৷ তাতে অনেক ফুল৷ আর কী সুন্দর গন্ধ!’ এ-কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে পকেট থেকে রুমালের একটা পোঁটলা বের করে ফেলেছে অজয়৷ রুমালের ঢাকনা সরাতেই প্রকাশিত হল একরাশ কাঠগোলাপ ফুল৷ তাদের অসংখ্য সাদা পাপড়ি৷ আর অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ৷
স্যারের দিকে ফুলের আঁজলা বাড়িয়ে অজয় বলল, ‘আপনি এগুলো নিন, স্যার—খুব সুন্দর ফুল…৷’
পীতাম্বরবাবু পলকে আবার পালটে গেলেন৷ অশোকের স্কেল টেবিলে রেখে অজয়ের হাত থেকে ফুলগুলো নিলেন৷ সেগুলো টেবিলে রেখে অজয়ের চুল ঘেঁটে দিয়ে বললেন, ‘এত সুন্দর প্রাইজ কেউ কখনও আমায় দেয়নি রে! কিন্তু তাই বলে এত বড় রিসক কেউ নেয়৷ যদি পড়ে-টড়ে যেতি! যা, ডেস্কে গিয়ে বোস…৷’