সাহস করে মিত্যুনবাবু ওকে লাঠি দিয়ে জোরালো একটা খোঁচা দিলেন৷ ছেলেটা সঙ্গে-সঙ্গে কাত হয়ে গেল৷ হেলে পড়ল একজোড়া বাঁশের ওপরে৷
‘ব্যাটা ঠান্ডায় অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি?’
‘দেখুন, দেখুন—মিত্যুনবাবুর প্যাকেটটা এখনও হাতে ধরে আছে৷ মিত্যুনবাবু, আপনি খুব লাকি—আপনার টাকা ফেরত পেয়ে গেলেন৷ ব্যাটা ওটা হজম করতে পারেনি—৷’
সকলে সেই কথায় সায় দিয়ে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ করে উঠল৷
আরও কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচির পর সবাই যখন বুঝতে পারল ছেলেটা একেবারে নিস্তেজ, তখন তারা ওর কাছে এগিয়ে গেল৷ ওকে ধরে চ্যাংদোলা করে বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বের করে নিয়ে এল বাইরে৷ শুইয়ে দিল মাটিতে৷
এবং সবাই চমকে উঠল—একেবারে ভূত দেখার মতো৷
এ তো বোবা কানাই! বেনিয়ামোড়ের কাছে নরসিং জানার চায়ের স্টলের পাশে বসে ভিক্ষে করে!
সেইজন্যই কাল রাত থেকে ও কোনও কথা বলেনি—বলতে পারেনি৷
ঝুঁকে পড়ে ওকে পরীক্ষা করল কয়েকজন৷ হাত রাখল নাকের নীচে, কানের নীচে৷ একজন তো ছেলেটার বুকে কান চেপে ধরল৷
তারপর, ধীরে-ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল৷
এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল সবাই৷ না, কানাই আর বেঁচে নেই৷
মিত্যুনকাকু হঠাৎই নীচু হয়ে কানাইয়ের ডানহাতে ধরা কাগজের প্যাকেটটা নিতে হাত বাড়ালেন৷ কিন্তু তার আগেই কৌতূহলী আর-একজন প্যাকেটটা তুলে নিয়ে খুলতে শুরু করেছে৷
কে একজন বলল, ‘যাক, মিত্যুন—তোমার টাকাটা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল…৷’
ততক্ষণে প্যাকেট খোলা হয়ে গেছে৷ প্যাকেট বলতে সাধারণ কাগজের ঠোঙা—কয়েকটা ভাঁজ দেওয়া৷
প্যাকেট খুলতেই সবাই আরও অবাক৷
প্যাকেট থেকে বেরিয়ে পড়েছে টাকা নয়—কয়েকটা হাতে গড়া আটার রুটি৷
সবাই অবাক চোখে মিত্যুনবাবুর দিকে তাকাল৷
মিত্যুনবাবু তখন চোখ নামিয়ে মাথা নীচু করে ফেলেছেন৷
সোমের বাবা বললেন, ‘মিত্যুন, তুমি এত বড় মিথ্যুক! চুরিটাকে বড় করে দেখানোর জন্যে এরকম মিথ্যে কথা বললে! তোমার মিথ্যের জন্যে একটা ছেলের…একটা ছেলের প্রাণ গেল!’
মিত্যুনবাবু একেবারে চুপ৷ মাথা নীচু৷
শুধু মিত্যুনবাবু কেন, কানাইয়ের মৃতদেহ ঘিরে সবাই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল৷ দেখে মনে হচ্ছিল, কানাই নয়, ওরা ওদের বিবেকের মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ওরাই যেন আসলে চোর—কানাই ওদের হাতেনাতে ধরে ফেলেছে৷