ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম৷ পলকের মধ্যে বাইরের মাঠে চলে এলাম৷ কিন্তু আঘাত এড়াতে পারলাম না৷ একটা পাত চাপড়ের মতো এসে লাগল আমার পিঠে৷ আর দ্বিতীয়টা নিনজা স্টারের মতো আমার বাঁ-হাতের বাহুকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল৷
পড়ে যেতে-যেতে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিলাম৷ রক্তপাত, যন্ত্রণা সব ভুলে গিয়ে ছুটে চললাম৷ দেখলাম, আরও কিছুটা দূরে দুটো কালো ছায়া দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে৷ তাদের একজনের হাতে ত্রিশূল আর কমণ্ডলু৷
আকাশ অন্ধকার৷ ঘোর কালো মেঘ জমাট বেঁধে আছে আকাশ জুড়ে৷ বৃষ্টি পড়ছে, তবে তেমন জোরে নয়৷ বৃষ্টিতে মাঠটা কাদা-কাদা হয়ে গেছে৷
টের পেলাম, অভিশপ্ত বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসার পর আমার দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেছে৷
টলতে-টলতে হাঁপাতে-হাঁপাতে আরও কিছুটা ছুটে চলার পর পণ্ডিতজী আর মহাবীর যাদবের কাছে পৌঁছলাম৷ দেখলাম, ওঁরা দুজনেও হাঁপাচ্ছেন৷
আমরা কেউ কোনও কথা বলছিলাম না৷ বৃষ্টিতে ভিজছিলাম আর তাকিয়ে ছিলাম ছায়া রঙের ভাঙাচোরা বাড়িটার দিকে৷ ওটার দরজা দিয়ে আগুনের আভা চোখে পড়ছিল৷
আমি বাঁ-হাতের কাটা জায়গাটায় হাত চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম৷ জায়গাটা ভীষণ জ্বালা করছিল৷ আর পিঠটা যেন পুড়ে যাচ্ছিল৷
হঠাৎই একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমার চোখে পড়ল৷
‘ঘট-ঘট-ঘটাং’ করে প্রচণ্ড এক শব্দ ভেসে এল বাড়িটা থেকে৷ তারপরই আগুনের আভাটা আগুনের শিখা হয়ে গেল৷ জ্বলন্ত লিফটটা কীভাবে যেন চলে এসেছে সদর দরজার কাছে৷ তারপর…৷
তারপর যা হল, সেটা এত বছর পরেও বিশ্বাস হতে চায় না৷
পুরোনো বাড়ির দরজা ভেঙে জ্বলন্ত লিফটটা টলতে-টলতে বেরিয়ে এল দরজার বাইরে৷ লিফটের প্রবল ধাক্কায় ফ্রেমসমেত দরজাটা তো ভেঙে পড়লই, তার লাগোয়া দেওয়াল থেকে একগাদা ইট খসে গিয়ে এক প্রকাণ্ড হাঁ তৈরি হয়ে গেল৷
তারপর সেই ভয়ংকর লিফটটা আমাদের লক্ষ্য করে ছুটে আসতে লাগল৷
জলকাদা ভরা মাঠের ওপর দিয়ে টলতে-টলতে টাল খেতে-খেতে দানবের মতো প্রকাণ্ড জ্বলন্ত লিফটটা ছুটে আসছে৷ ওটার অভিঘাতে বৃষ্টির জল ছিটকে যাচ্ছে চারপাশে৷ বৃষ্টির ফোঁটা ওটার লাল গনগনে শরীরে পড়ামাত্রই হয়তো ‘ছ্যাঁক-ছোঁক’ শব্দ হচ্ছিল, কিন্তু ইস্পাতের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষের শব্দে সেই শব্দ কানে আসছিল না৷
আমরা ভয়ে ছুটতে শুরু করলাম আবার৷ তবে ‘আমরা’ মানে দুজন: আমি আর মহাবীর যাদব৷
পেছনে তাকিয়ে দেখি, রামপ্রসাদজী রুখে দাঁড়ানো যোদ্ধার মতো দু-পা ফাঁক করে ডানহাতে ত্রিশূল উঁচিয়ে মারমুখী ভঙ্গিতে ছুটে আসা লিফটটার জন্যে যেন অপেক্ষা করছেন৷ ছিপছিপে লম্বা মানুষটার শরীরের সমস্ত ভয়-ডর যেন উবে গেছে৷
‘জয়-জয় শিবশম্ভু!’ গর্জে উঠলেন রামপ্রসাদ৷ অন্ধকার আকাশ-বাতাস যেন কেঁপে উঠল৷ তারপর মানুষটা গরগর রাগে গলা ফাটিয়ে বললেন, ‘আ যা, শয়তান! তু শিবজী কো নহি মানতা? শিবজী তুঝে আভি নাশ করেঙ্গে৷ শিবজী কা পাওয়ার তুঝে নহি মালুম! আ যা…৷’
লিফটটা রামপ্রসাদজীর খুব কাছে এসে গিয়েছিল৷ আমি আশঙ্কা আর কৌতূহলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ এই পাগল পণ্ডিতজীকে এখন আমি কী করে বাঁচাই!
‘পণ্ডিতজী!’ চিৎকার করে ওঁকে ডাকলাম৷ কিন্তু তিনি ফিরেও তাকালেন না৷
মহাবীর যাদব তখন ‘দাওয়াই টাউন’-এর সীমানার বাইরে চলে গেছেন৷ সেখান থেকে বারবার ‘পমেশজী! পমেশজী!’ করে আমাকে ডাকছেন৷
অভিশপ্ত লিফটটা যখন পণ্ডিতজির বেশ কাছে এসে গেছে তখন তিনি ‘জয় শিবশম্ভু!’ বলে জ্বলন্ত লোহার বাক্সটাকে লক্ষ্য করে হাতের ত্রিশূল ছুড়ে দিলেন৷
পলকে এক বিস্ফোরণ ঘটে গেল৷ প্রচণ্ড শব্দে বোমার মতো ফেটে গেল লিফটটা৷ হাজার টুকরোয় চুরচুর হয়ে অসংখ্য আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে গেল বৃষ্টি-ভেজা বাতাসে৷ আর তার সঙ্গে শোনা গেল একরাশ বাচ্চার যন্ত্রণা ও বেদনা মেশানো কান্না৷ নিচু পরদায় শুরু হয়ে ক্রমশ উঠে গেল উঁচু গ্রামে৷ তারপর কেঁপে-কেঁপে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল৷
আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল৷
আমি আবার চিৎকার করে ডাকলাম, ‘পণ্ডিতজী! পণ্ডিতজী!’
রামপ্রসাদ তিওয়ারি থরথর করে কাঁপছিলেন৷ আমার ডাকে ফিরে তাকাতে গিয়ে তিনি বোধহয় মাথা ঘুরে খসে পড়ে গেলেন ভেজা মাটিতে৷
আমি ছুটে গিয়ে ওঁকে তুলে দাঁড় করালাম৷ টের পেলাম, ওঁর শরীরটা তখনও কাঁপছে৷ আমার বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে৷
মহাবীরজী ছুটে চলে এলেন আমাদের কাছে৷ আমার একটা হাত জাপটে ধরলেন৷
আমরা তিনজন পরস্পরকে ছুঁয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তাকিয়ে রইলাম হসপিটাল বিল্ডিংটার দিকে৷
আজ যতই ঝড়-বৃষ্টি হোক, কালকের নতুন সকালটা যেন অমলিন সুন্দর হয়৷
সমাপ্ত