নানান ফ্লোরে যাওয়ার জন্যে লিফটের ভেতরে একটা বড়সড় পেতলের হাতল রয়েছে, কিন্তু ইন্ডিকেটর ল্যাম্পের কোনও প্যানেল নেই৷
লিফটটা মাপে প্রকাণ্ড৷ অন্তত পঁচিশ-তিরিশজন তার ভেতরে অনায়াসে এঁটে যাবে৷ আমরা চারজন জড়সড়ো হয়ে লিফটের মাঝখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম৷ এখন শুধু একটাই চিন্তা: কোনওরকমে এই বিল্ডিং-এর বাইরে বেরোতে পারলে হয়!
হঠাৎই আমরা চারজন কেমন যেন পিছিয়ে যেতে লাগলাম৷
‘কী হচ্ছে? কী হচ্ছে?’ বলতে-বলতে টের পেলাম সামনে থেকে চাপ আসছে—যেন আরও অনেক লোকজন গাদাগাদি করে উঠে পড়েছে লিফটে৷ আমি এপাশ-ওপাশ টর্চের আলো ফেললাম৷ এবং ভয়ে চমকে উঠলাম৷
তাল-তাল কুয়াশার পিণ্ড লিফটের মধ্যে হাজির হয়েছে৷ ওদের চাপে আমরা কোণঠাসা হয়ে গেছি৷
ওরা কারা? ওদের স্পর্শই বা কেন এত ঠান্ডা লাগছে শরীরে?
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমি ভালোরকম ভয় পেয়েছিলাম৷ কিন্তু মোহন যাদবের মতো একজন শক্তসমর্থ যুবক আমার চেয়ে ভয় পেয়েছে অনেক বেশি৷ ও ভয়ে চোখ বুজে আমার ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে রয়েছে৷ ওর মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে৷
মহাবীরজীর দিকে টর্চের আলো ফেলে দেখি তিনি যেন দাঁড়িয়ে থাকা এক কাঠের পুতুল৷
রামপ্রসাদ তেওয়ারি তেমন একটা ভয় পেয়েছেন বলে মনে হল না৷ ওঁর ঠোঁটে সেই একই মন্ত্র—যে-মন্ত্রের ওপরে ওঁর ভরসা আছে, বিশ্বাসও আছে৷
এমন একটা সময়ে ‘কড়কড় কড়াৎ’ শব্দে ভয়ংকর এক বাজ পড়ল খুব কাছে৷ বাজের সাদা আলোর ঝলকানিতে কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধ হয়ে গেলাম৷ বাজের দুশো ডেসিবেল লেভেলের আওয়াজ আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দিল৷
কোথায় যেন আগুন ধরে গেল৷ খুব তীব্র পোড়া গন্ধ আসছে নাকে৷ কিছু পুড়ে যাওয়ার ‘চড়চড়’ শব্দ হচ্ছে কোথাও৷
হঠাৎই টের পেলাম লিফটের দেওয়ালটা উনুনে বসানো হট প্লেটের মতো গরম হয়ে উঠেছে৷ পিঠে যেন ছ্যাঁকা লাগছে৷
লিফটটা একতলায় নেমে গিয়েছিল৷ কিন্তু সেখানে না থেমে বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে আবার দুরন্ত গতিতে উঠতে শুরু করে দিল ওপরে৷ আমরা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করলাম৷
সে একটা সাংঘাতিক অবস্থা!
লিফটটা অসহ্য ঝাঁকুনি দিয়ে ওপরে উঠছে৷ কানফাটানো শব্দ হচ্ছে ‘ঘট-ঘট-ঘটাং’৷ সঙ্গে আমাদের ভয়ের চিৎকার৷
তার সঙ্গে হঠাৎই জড়িয়ে গেল চাপা কান্নার শব্দ৷ মিহি গলার আওয়াজে অনেকে মিলে কাঁদছে৷ আর্ত কলরোল ভেসে বেড়াচ্ছে লিফটের বদ্ধ বাতাসে৷
আমরা চিৎকার থামিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম৷ কারা কাঁদছে? কোথায় কাঁদছে?
মহাবীর যাদব আচমকা ‘লছমি! লছমি!’ বলে হাহাকার করে উঠলেন৷
কান্নার রোল ক্রমে জোরালো হতে লাগল৷ আমাদের ঘিরে সেই আর্ত শব্দতরঙ্গ লিফটের ভেতরে ঘুরপাক খেতে লাগল৷
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আদিম লোহার খাঁচাটা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল৷ এবং পরক্ষণেই মাতালের মতো টলতে-টলতে প্রবল গতিতে নীচের দিকে ছুটে চলল৷
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘লিফটটা একতলায় গেলেই আমাদের দরজা খুলে বাইরে লাফ মারতে হবে৷ যেমন করে হোক৷ তা না হলে আমাদের অবস্থা হবে ওই সাতাশটা বাচ্চার মতো…!’
‘সহি কহা হ্যায় মাস্টারজীনে৷ আপ সব রেডি হো যাইয়ে—৷’ রামপ্রসাদ তিওয়ারি বললেন৷
রেলগাড়ি শান্টিং-এর সময় যেরকম শব্দ হয় ঠিক সেরকম শব্দ তুলে লিফটটা একতলায় এসে বলতে গেলে আছড়ে পড়ল৷
আমরা চারজন একসঙ্গে কোলাপসিবল গেট ধরে টান মারলাম৷ গেট খুলল না৷ আবার টান মারলাম৷
লিফটের আঁচে শরীর ঝলসে যাচ্ছে৷ দরদর করে ঘামছি৷ আর কিছুক্ষণ এই অভিশপ্ত খাঁচায় বন্দি থাকলে আমরা সবাই পুড়ে শেষ হয়ে যাব৷ প্রাণপণ শক্তিতে ভাঙা কোলাপসিবল গেটটা ধরে আরও একবার টান মারলাম৷
তৃতীয়বারের চেষ্টায় গেটটা খুলে গেল৷
আমরা দরজা ডিঙিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ামাত্রই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷
আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ কানে তালা লেগে গেল৷ পেছনে তাকিয়ে দেখি লিফটটায় আগুন ধরে গেছে৷ ওটার দেওয়ালে তালি মারা ইস্পাতের পাতগুলো খসে-খসে পড়ছে৷
আমরা টর্চের আলোয় সদর দরজাটা দেখতে পেলাম৷ তা ছাড়া আগুনের আভাও আমাদের বাড়তি সাহায্য করল৷ একটুও দেরি না করে আমরা সদর দরজা লক্ষ্য করে ছুট লাগালাম৷
কিন্তু হঠাৎই দেখি দু-তিনটে লোহার পাত আমাদের পেছন-পেছন শূন্যে বাতাস কেটে ধেয়ে আসছে৷ শিকারি বাজ যেভাবে তিরবেগে ধেয়ে আসে৷
প্রাণ বাঁচাতে আরও জোরে ছুটতে শুরু করলাম৷ কিন্তু একটা উড়ন্ত ‘বাজপাখি’ মোহন যাদবকে ধরে ফেলল৷ সরাসরি ওর ঘাড়ে এসে আঘাত করল৷ একেবারে তরোয়ালের কোপের মতো৷
মোহনের দেহটা মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে৷
একপলকের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷
মোহনের মাথাটা কোনওরকমে দেহের সঙ্গে আটকে আছে৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফাটল ধরা ধূলিমলিন মেঝে৷ ওর চোখ দুটো মরা মাছের মতো চেয়ে আছে সিলিং-এর দিকে৷
কী মর্মান্তিক মৃত্যু!
প্রথমবারে মোহন যাদব বেঁচে গিয়েছিল৷ গাল আর গলায় কোপ লাগলেও সেরে উঠেছিল৷ সেদিন ও গাঢ় অন্ধকারে বুঝতে পারেনি কে বা কী ওকে আক্রমণ করেছে৷
ছোকরু আর মুন্নার রহস্যময় মৃত্যুর কারণও এবার বুঝতে পেরেছি আমি৷
লিফট! ওই অভিশপ্ত লিফট!
রামপ্রসাদজী আর মহাবীর যাদব দরজা পেরিয়ে বাইরে চলে গেছেন৷ কয়েক মুহূর্ত দেরি করায় আমি একটু পিছিয়ে রয়েছি৷ কিন্তু ছুটে চলেছি আবার৷ সেই অবস্থাতেই পেছনে তাকিয়ে দেখি, ছোট মাপের দুটো উড়ন্ত পাত ছুটে আসছে আমাকে লক্ষ্য করে৷ তাপে পাতদুটো লালচে হয়ে গেছে৷