মোহন যাদব ভয় পেয়ে আমার হাত চেপে ধরল: ‘মাস্টারসাব, ফিরে চলুন৷ পণ্ডিতজী ঠিক বলেছেন৷ এই ফ্লোরে কিছু তো গড়বড় আছে! দেখছেন না, অচানক বৃষ্টি কীরকম জমিয়ে এল৷ তার সঙ্গে কীরকম মেঘ ডাকছে, বাজ পড়ছে!’
ওর কথা শেষ হতে না হতেই ‘কড়কড় কড়াৎ’ শব্দে বাজ পড়ল৷ আমরা তিনজনেই কেঁপে উঠলাম৷ তীব্র সাদা আলোয় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ রামপ্রসাদজী তখন আমাদের তিনজনের কাছ থেকে অনেকটা দূরে—দিশেহারাভাবে কমণ্ডলু আর টর্চ নিয়ে ঘরের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন৷
মহাবীর যাদব হঠাৎই একটা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া লোহার খাটের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন৷ ওঁর হাত থেকে লাঠি আর টর্চ খসে পড়ল৷ তারপর খাটে মাথা ঠুকতে লাগলেন আর ভাঙা গলায় কাঁদতে লাগলেন৷
‘লছমি! লছমি! এই বেডেই লছমি ছিল৷ ইসি বেডমেই উও থি, পমেশজী, ইসি বেডমে…৷’
আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷
হঠাৎই আমাদের টর্চের আলোয় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ধরা পড়ল৷
কালো কুয়াশার পিণ্ডের মতো কতকগুলো গাঢ় ছায়া ঘরের মধ্যে নড়ে বেড়াচ্ছে৷ কখনও ওরা এদিকে-ওদিকে ছুটে যাচ্ছে, কখনও লাফিয়ে উঠে পড়ছে লোহার খাটগুলোর ওপরে৷ কখনও বা একটা ছায়ার পিণ্ড আর-একটা পিণ্ডের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে৷
দুটো ছায়ার পিণ্ড আমার আর মোহনের কাছে এগিয়ে এসেছিল৷ মোহন ভয় পেয়ে ওগুলোর ওপরে লোহার রড চালিয়ে দিল৷ রড নেহাতই বাতাস কেটে একটা খাটে গিয়ে লাগল৷ আর মোহন ভয়ে চিৎকার করে উঠল৷
পরিস্থিতি আমারও ভালো ঠেকছিল না৷ তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যেতে পারলে হয়৷ বাইরের দুর্যোগের সঙ্গে হয়তো মোকাবিলা করা যায়, কিন্তু ভেতরের এই দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করব কেমন করে?
কী মনে হওয়ায় রামপ্রসাদ তেওয়ারির দিকে টর্চের আলো ফেললাম৷ এবং যা দেখলাম তাতে আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল৷ বরফজলের স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে৷
পাশবালিশের মতো কতকগুলো জমাট কুয়াশার পিণ্ড রামপ্রসাদজীর শরীরের সঙ্গে যেন লেপটে আছে৷ ওগুলো বোধহয় রামপ্রসাজীকে এলোমেলোভাবে ঠেলা মারছিল, কারণ, পণ্ডিতজীর শরীরটা টলে যাচ্ছিল বারবার৷ কিন্তু ওঁর সাহস সত্যিই প্রশংসা করার মতো৷ কারণ, ওই কুয়াশা-পিণ্ডগুলোর ধাক্কা সামলে পণ্ডিতজী ওগুলোর ওপরে কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে চলেছেন, শিবশম্ভুর নাম নিয়ে চলেছেন অবিরাম৷
আবার ভয়ংকর শব্দে বাজ পড়ল৷
সাদা আলো আর শব্দের পাশাপাশি আরও একটা বিপর্যয় ঘটে গেল৷ পাঁচতলার একটা অংশ ভেঙে পড়ল৷
টর্চের আলোয় একটু আগেই যেখানে দেওয়াল দেখতে পাচ্ছিলাম সেখানে এখন শূন্যতা আর ঝোড়ো বৃষ্টি৷ বৃষ্টির ঝাপট সাইক্লোনের মতো পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল ঘরের মধ্যে৷ ঠিক সেই সময়ে ‘ঘটাং! ঘটাং!’ শব্দ কানে এল৷ সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক সংকটের কাল৷
হঠাৎই আমার মনে হল, আর এক মুহূর্ত যদি এখানে অপেক্ষা করি তা হলে আমাদের সর্বনাশ হবে৷
মোহন যাদব আমার হাত জাপটে ধরল৷ ও ধুম জ্বরের রুগির মতো থরথর করে কাঁপছে৷
আমি চিৎকার করে মহাবীর যাদবকে ডাকলাম, ‘মহাবীরজী, জলদি আসুন—এবার পালাতে হবে—!’
মোহন ‘রামপরসাদজী! পণ্ডিতজী!’ বলে ডাকতে লাগল আতঙ্কে৷
মহাবীর যাদবও নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছিলেন, কারণ, আমার ডাকের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তিনি ছুট লাগালেন সিঁড়ির দিকে৷
আমি আর মোহনও দেরি করলাম না—ছুট লাগালাম ওঁর পেছন-পেছন৷ সেই অবস্থাতেই টের পেলাম, রামপ্রসাদ তেওয়ারিও আমাদের পেছনে ছুটে আসছেন৷
পোড়া গন্ধটা এখনও নাকে টের পাচ্ছিলাম, কিন্তু ঠান্ডা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাপারটা ঝড় আর বৃষ্টি চাপা দিয়ে দিয়েছে৷
ছুটে আমরা চারজনে যখন সিঁড়ির কাছে এসে পৌঁছলাম তখন আসল সর্বনাশটা দেখতে পেলাম৷ বাজ পড়ার দাপটে জরাজীর্ণ সিঁড়িটার পাঁচতলার প্রায় পুরো অংশটাই ধসে পড়েছে নীচে৷
আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ মহাবীর যাদবের টর্চ আর লাঠি কোথায় ছিটকে পড়ে গেছে কে জানে! তখনও মানুষটা কাঁদছে আর ওর বোনের নাম বিড়বিড় করছে৷
ভয়ংকর শব্দে বাজ পড়ল আবার৷
তখনই আমার চোখ গেল বেঢপ লিফটটার দিকে৷
ওটার দরজা খোলা৷ দরজার পাশে লাল আলোয় লেখা তিরচিহ্ন জ্বলছে৷ জ্বলছে ‘চার’ লেখাটাও৷ কিন্তু লিফটটা পাঁচতলায় কখন এল? কেমন করে এল?
লিফটের খোলা দরজাটা দেখে আমার মনে হল, ওটাই পালানোর একমাত্র পথ৷
‘ঘট-ঘটাং৷ ঘট-ঘটাং!’ শব্দ ভেসে এল ইস্পাতের বাক্সটার দিক থেকে৷ ওটা যেন আমাদের ডাকছে৷
নিশির ডাকের মতো একটা মায়া আমাকে জড়িয়ে ধরল৷ আমি ছুটলাম লিফটের দিকে৷ আমার পেছন-পেছন বাকি তিনজন৷
আমরা চারজন ঢুকে পড়তেই নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল লিফটের ভাঙা দরজা৷ এবং লিফটটা নিজে থেকেই চলতে শুরু করল৷
মোহন যাদব কাঁপা গলায় বলল, ‘ইয়ে সব কেয়া হো রহা হ্যায়? এই শয়তান লিফটটাকে কে চালাচ্ছে?’
আমি কোনও জবাব দিলাম না৷ টর্চের আলোয় লিফটটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম৷ এককথায় বলতে গেলে জং ধরা জরাজীর্ণ একটা লোহার বাক্স৷ চলার সময় ওটা থরথর করে কাঁপছে৷ ‘ঘট-ঘট-ঘটাং’ শব্দ হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে, এই বুঝি ইস্পাতের চাদরের জোড়াতালিগুলো খসে পড়বে—কিন্তু খসে পড়ছে না৷
লিফটটা কোন তলায় যাচ্ছে জানি না, তবে যাচ্ছে যে নীচের দিকেই সেটা টের পাচ্ছি৷