দোতলার কাজ সেরে তিনতলা৷ তিনতলার পর চারতলা৷ এবং চারতলার পর পাঁচতলা৷ পাঁচতলা তো নয়, ‘মরণতলা’৷
এর মধ্যেই মেঘের গর্জন বাড়ছিল—বেশ ঘন-ঘন শোনা যাচ্ছিল৷ আর জানলার খোলা অংশ দিয়ে বাইরে তাকালে গাঢ় অন্ধকার৷ বিল্ডিং-এর ভেতরের চাপ-চাপ অন্ধকারের সঙ্গে সেই অন্ধকার যেন হাত মিলিয়ে নিয়েছে৷
পাঁচতলায় এসেই মহাবীর যাদব ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিলেন৷ শত সান্ত্বনাতেও সে-কান্না আর থামতে চায় না৷ কান্নার মাঝে-মাঝেই তিনি ‘লছমি! লছমি!’ বলে ডেকে উঠছিলেন৷
বাইরে যে বৃষ্টি নেমে গেছে সেটা বোঝা গেল বৃষ্টির শব্দে আর গন্ধে৷ আর এই পাঁচতলায় এসে পৌঁছানো মাত্র পোড়া গন্ধটা পাগলের মতো আমাদের জড়িয়ে ধরল৷
প্রথমেই দুটো ছোট-ছোট ঘর৷ ঘর না বলে ঘরের ধ্বংসাবশেষ বলাই ভালো৷ প্রথম ঘরটায় দুটো টেবিল, চারটে চেয়ার, একটা আলমারি, আর একটা র্যাক৷ সবগুলোই পোড়া এবং ভাঙাচোরা৷ ধুলোময় নোংরা মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছে৷ মাথার ওপরে একটা সিলিং ফ্যান—পুড়ে কালো হয়ে গেছে৷ তার ব্লেড তিনটে সাপের মতো এঁকেবেঁকে নীচের দিকে ঝুলছে৷
ঘরটা দেখে মনে হয়, এককালে ডাক্তার-নার্সরা এই ঘরে বসত৷
তার পাশের ঘরটা বোধহয় ওষুধপত্রের স্টোর রুম ছিল৷ কারণ, ঘরে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা তিনটে র্যাক৷ র্যাকে অনেক শিশি-বোতল আর প্যাকেট৷ কিন্তু তার বেশিরভাগই ভাঙাচোরা, পুড়ে কালো হয়ে গেছে৷ ঘরের সিলিং ফ্যানটারও অষ্টাবক্র দশা৷
ঘরটার মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ধুলোমাখা কাচের টুকরো আর নানান জিনিসপত্র৷ এক অদ্ভুত ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরের বাতাসে৷
দুটো ঘরেই মন্ত্রপূত শান্তির জল ছিটিয়ে দিলেন রামপ্রসাদজী৷ দ্বিতীয় ঘরটায় এসে আমাদের বললেন, ‘আপনারা সবাই শিবজীর নাম নিন৷ ইয়ে ভুলিয়েগা মত কে ভূত-পিরেত যো ভি হ্যায় সব শিবশম্ভুকা গুলাম হ্যায়৷ জয়-জয় শিবশম্ভু!’
রামপ্রসাদজীর জিগির শেষ হওয়ামাত্রই আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানটা ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ শব্দে ঘুরতে শুরু করে দিল৷
চমকে ওপরে তাকিয়ে দেখি, আঁকাবাঁকা পোড়া ব্লেডগুলো ঘোরার চেষ্টায় থরথর করে কাঁপছে৷
রামপ্রসাদজী ফ্যানটা লক্ষ্য করে শান্তির জল ছুড়ে দিলেন৷ কিন্তু ভয় পাওয়া মোহন যাদব একটা গালাগাল দিয়ে জ্যান্ত হয়ে ওঠা ফ্যানটার গায়ে মরিয়া শক্তিতে লোহার রডের এক ঘা বসিয়ে দিল৷ আমরা কেউ মোহনকে বাধা দেওয়ার কোনও সময়ই পেলাম না৷
যেটা আমাদের সবচেয়ে বেশি অবাক করল সেটা হল, রডের আঘাতের সঙ্গে-সঙ্গে যন্ত্রণার একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল৷ ঠিক কোথা থেকে সে-আর্তনাদ ভেসে এল সেটা আমরা কেউই ঠাহর করতে পারলাম না৷
রামপ্রসাদ তেওয়ারি আর মহাবীর যাদব প্রায় একইসঙ্গে মোহনকে ধমক দিলেন৷ মোহন মিনমিন করে বলল যে, ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷
ভয় কি আমরাও পাইনি? আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে৷
এরপর যে শব্দটা শুনতে পেলাম সেটা আরও রহস্যময়: ঘর থেকে কয়েকজন যেন ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল৷
আমরা টর্চের আলো এদিক-ওদিক ঘুরিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না৷ তখন নিজেদের মধ্যে এলোমেলো কথা বলতে লাগলাম৷ মোহন বলল, ‘চলুন, তাড়াতাড়ি কাজ সেরে আমরা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যাই—৷’
মহাবীরজী ওকে একটু ধমকের গলায় বললেন, ‘একা-একা যখন এই ভূতিয়াঘরে ঢুকেছিলে তখন ভয় পাওনি!’
‘আমি তো শুধু একতলায় ঢুকেছিলাম৷ আর এখন তো প্রত্যেকটা ঘরে ঢুকে-ঢুকে সবাইকে ডিসটার্ব করছি—৷’
‘সবাইকে মানে?’
‘সব আতমাদের৷ তার মধ্যে…তার মধ্যে আপকা বহিন ভি হ্যায়…৷’
মহাবীর যাদব কেঁদে ফেললেন এ-কথায়৷ বললেন, ‘আমি আমার বহিনের আতমার মুক্তি চাই…শান্তি চাই…৷’
আমি ওদের চুপ করতে বললাম৷ ওরা চুপ করে গেল৷ রামপ্রসাদজী সর্বক্ষণ বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে চলেছেন৷ তারই মধ্যে লোহার সঙ্গে লোহার সংঘর্ষের শব্দ শোনা যাচ্ছিল বারবার: ‘ঘট-ঘটাং, ঘট-ঘটাং…৷’
আমরা এবার আর-একটা ঘরে ঢুকলাম৷ ঢুকেই বুঝলাম সেটা পেশেন্টদের ওয়ার্ড৷ কারণ, এই প্রথম ফিনাইলের গন্ধ আমাদের নাকে ঝাপটা মারল৷ পোড়া গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়ে সেই গন্ধটা এমন দাঁড়াল যে, সেটাকে ঠিকঠাকভাবে বোঝানো বেশ কঠিন৷
টর্চের আলো ফেলে বুঝলাম ঘরটা মাপে অনেক বড়৷ দু’পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোহার খাট৷ তার বেশ কয়েকটা ভাঙা, বেঁকেচুরে গেছে৷ খাটের ওপরে গদিগুলো সব আধখাওয়া, ছেঁড়াখোঁড়া৷
টর্চের আলোয় কয়েকটা বড়সড় ইঁদুরকে ছুটে পালাতে দেখলাম৷
মহাবীরজী এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না—বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে শুরু করলেন৷
বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে৷ তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, মেঘের ‘গুড়-গুড়-গুড়-গুড়ুম’ আর বিদ্যুতের চমক৷ হঠাৎ করে আবহাওয়া এতটা খারাপের দিকে গেল কেমন করে?
কয়েকটা জানলার পাল্লা হয় ছিল না, অথবা খুলে গিয়েছিল৷ প্রবল বাতাসে জলের মিহি গুঁড়ো অন্ধকার ঘরের ভেতরে পাক খেতে লাগল৷ তারই মধ্যে বরফের মতো ঠান্ডা বাতাস আমাদের শরীরে নিয়মিত ছন্দে পড়তে লাগল৷
রামপ্রসাদজী চেঁচিয়ে বললেন, ‘হমে কুছ গড়বড় লগতা হ্যায়৷ ইয়ে ফ্লোর কা কাম জলদি-জলদি খতম করনা জরুরি হ্যায়—৷’ বলেই আর দেরি করলেন না, শান্তির জল ছেটাতে-ছেটাতে প্রায় দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিলেন৷