আমি ওঁকে ভরসা দেওয়ার জন্যে বললাম, ‘বোধহয় কোনওভাবে বিজলির কানেকশান থেকে গেছে—৷’
আমরা চারজনে বেশ বিমূঢ় অবস্থায় লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ওটার গায়ে টর্চের আলো বোলাতে লাগলাম৷ পোড়া গন্ধটা আমাদের নাকে আরও জোরালো হল৷ আমাদের ঘিরে থাকা শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ চলতে লাগল৷ ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা দিব্যি টের পাচ্ছিলাম৷ আমার গা শিরশির করছিল৷
টর্চের আলোয় লিফটটাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম৷
ইস্পাতের চাদর দিয়ে তৈরি প্রকাণ্ড মাপের একটা লোহার বাক্স৷ সেই চাদরে আবার নানান জোড়াতালি৷ কোথাও-কোথাও স্টিলের শিটের টুকরো নাট-বলটু দিয়ে অথবা ওয়েলডিং করে তাপ্পি মারা হয়েছে৷ ইস্পাতের চাদরের সারা গায়ে গুটি বসন্তের দাগের মতো ছোট-বড় চাকা-চাকা গর্ত—কোন এক অজানা কারণে টোল পড়ে গেছে৷ চাদরগুলো সব ঢেউ-খেলানো, উঁচু-নীচু৷ তার সারা গায়ে জং ধরা৷ সময় আর আগুন তার সব শক্তি, সব সৌন্দর্য শুষে নিয়েছে৷
লিফটের দরজা বলতে একটা ভাঙাচোরা তোবড়ানো জং ধরা কোলাপসিবল গেট৷ তার পাটিগুলোর বেশিরভাগই ক্ষয়ে-ক্ষয়ে খসে পড়ে গেছে৷
‘বাজ পড়ে আগুন লেগে গিয়েছিল বলে লিফটটার এই বুরা হাল৷ তারপর ত্রিশ-বত্রিশ সাল পেরিয়ে গেল…৷’ মহাবীরজী বললেন, ‘হসপিটালের সাতাশটা বাচ্চা এই লিফটের মধ্যেই খতম হয়ে গিয়েছিল৷ আমার বহিন…৷’ বলে ডুকরে উঠলেন মহাবীরজী৷ তারপর ‘লছমি! লছমি!’ বলে কাঁপা গলায় ডেকে উঠে কাঁদতে শুরু করলেন৷
‘রোনা-ধোনা বনধ৷’ ধমকে উঠলেন রামপ্রসাদ তেওয়ারি৷ তারপর: ‘জয় হো শিবশম্ভু!’ বলে হেঁকে উঠলেন৷ কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে দিলেন লিফটের গায়ে৷
গরম কড়াইয়ে জল ছিটিয়ে দিলে যেমন ‘ছ্যাঁক’ করে শব্দ ওঠে ঠিক সেরকম শব্দ শোনা গেল৷
আমি অবাক হয়ে লিফটের গায়ে টর্চের আলো ফেললাম৷ তিনটে টর্চের আলো লিফটের গায়ে ঘোরাঘুরি করছিল, তার সঙ্গে আমার চার নম্বর আলোটা যুক্ত হল৷ কিন্তু লিফটের গা থেকে বাষ্পের ধোঁয়া বেরোল কি না সেটা ঠিক ঠাহর হল না৷
মোহন ভয় পেয়ে গেল৷ বলল, ‘এসব কী হচ্ছে! ক্যায়সে হো রহা হ্যায়? কিঁউ হো রহা হ্যায়?’
আমি মোহনকে বকুনি দিলাম: ‘মোহন, তুমি কেন ভয় পাচ্ছ? আমাদের হাতে তো লাঠি আছে!’
মোহন চুপ করে গেল—যদিও ওর ভয় কমল কি না বোঝা গেল না৷
ঠিক তখনই ঠান্ডা বাতাসের শ্বাস-প্রশ্বাস আরও জোরালো হল৷ পোড়া গন্ধটা এত মারাত্মক বেড়ে গেল যে, মনে হল, আমরা শ্মশানে জ্বলন্ত চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ কিন্তু গায়ে কোনও আঁচ টের পাচ্ছি না৷
রামপ্রসাদজী বললেন, ‘চলুন, চলুন—ওপরে চলুন৷ বাকি ঘরগুলোয় কাজ শেষ করতে হবে—’ তারপর মহাবীর যাদবকে বললেন, ‘সিঁড়ি কোনদিকে?’
মহাবীর যাদব টর্চের আলো ফেলে সিঁড়ির দিকে এগোলেন৷ ওঁর পেছন-পেছন আমরা৷
সিঁড়িগুলোর অবস্থা শোচনীয়৷ রেলিং কোথাও আছে, কোথাও নেই৷ যেখানে রেলিং আছে সেখানেও জায়গায় জায়গায় জং ধরে খসে পড়ে গেছে৷ আর সর্বত্র ধুলো, ধুলো আর ধুলো৷ সিঁড়ির ধাপের বহু জায়গায় সিমেন্ট ভেঙে পড়েছে৷ কোথাও-কোথাও বড়সড় ফাটল৷ সিঁড়িতে পুরু ধুলো তো আছেই, তার সঙ্গে পড়ে আছে শুকনো গাছের পাতা, আধখাওয়া ইঁদুরের দেহ, পাখির পালক৷ পোড়া গন্ধটার সঙ্গে এখন কেমন একটা বোঁটকা দুর্গন্ধ মিশে গেছে৷
সিঁড়ি দিয়ে যখন আমরা উঠছি তখন হঠাৎই মেঘের ডাক শুনতে পেলাম৷ একইসঙ্গে শুনতে পেলাম লোহার ‘ঘট-ঘটাং’ শব্দ—বেশ কয়েকবার৷ মনে হল, কেউ যেন শব্দ করে নিজেকে জানান দিচ্ছে৷
মোহন বলল, ‘মাস্টারসাব, ইয়ে কেইসন আওয়াজ বা?’
‘ওসব আওয়াজে কান দিয়ো না৷ সাবধানে ওপরে ওঠো—৷’
মোহনকে সামাল দিলাম বটে, কিন্তু লোহায়-লোহায় সংঘর্ষের এই শব্দটা আমার মনে খচখচ করতে লাগল৷
দোতলায় উঠে আমরা একইভাবে টর্চের আলো ফেলে ঘর থেকে ঘরে ঘুরে বেড়ালাম৷ রামপ্রসাদ তেওয়ারি নির্ভয়ে শান্তি-স্বস্ত্যয়নের কাজ করতে লাগলেন৷ সেই সময়ে আমরা পরপর কয়েকবার মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম৷ একটু আগেও জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে তাকিয়ে যে আলোর জ্যামিতিক টুকরোগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম এখন সেসব উধাও৷ তা হলে বাইরের আকাশ কি মেঘে কালো হয়ে গেছে?
ঘরগুলোর কাজ সেরে আমরা কী মনে করে লিফটের দিকে এগোলাম৷ তা ছাড়া মহাবীর যাদব বারবার বলছিলেন, লিফটে ওঠার কোলাপসিবল দরজাগুলোও শোধন করা দরকার৷ তাই পায়ে-পায়ে আমরা পৌঁছে গেলাম লিফটের দরজার কাছে৷
কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার!
লিফটটা এসে দোতলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে! এবং দরজার পাশের প্যানেলে যে-লাল আলো জ্বলছে সেখানে ছবি সেই একই: তিরচিহ্ন এবং ‘চার’৷
মোহন আমার বাহু খামচে ধরল৷ আমি অন্ধকারে ওর হাতের ওপরে হাত রাখলামঃ ‘ভয় পেয়ো না৷ আমাদের কাজ শেষ হয়ে আসছে৷ আর বড়জোর আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট৷ তা ছাড়া আমরা তো তোমার সঙ্গে আছি, মোহন৷’
মোহন আমার হাতটা ছেড়ে দিল৷ আমার কথায় কতটুকু ভরসা পেল কে জানে!
আমি লিফটটার কথা ভাবছিলাম৷ ওটা চুপিচুপি দোতলায় উঠে এল কেমন করে! মান্ধাতার আমলের এইরকম বেঢপ চেহারার সার্ভিস লিফট ওঠা-নামা করলে অল্পবিস্তর শব্দ হওয়ার কথা৷ কিন্তু কোনওরকম শব্দ তো আমরা শুনিনি! শুধু ওই ‘ঘট-ঘটাং’ শব্দগুলো ছাড়া৷ কোনও লিফট ওঠা-নামা করলে এরকম যে শব্দ হয় সেটা আমার জানা ছিল না৷