ভয় পেয়ে এপাশ-ওপাশ টর্চ ঘোরাতেই আওয়াজের কারণটা বোঝা গেল৷
আলমারির পায়া ঘেঁষে লেপটে আছে একটা মোটাসোটা চন্দ্রবোড়া সাপ৷ তার মাথাটা সামান্য উঁচু হয়ে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে৷ চোখ জ্বলজ্বল করছে৷ ফোঁসফোঁস শব্দে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে- সঙ্গে কালো নকশার আলপনা আঁকা শরীরটা একবার ফুলে উঠছে, একবার চুপসে যাচ্ছে৷
মোহন লোহার রড মাথার ওপরে তুলে সাপটার দিকে দু-পা এগিয়ে গেল৷
‘মোহনজী, রুক যাইয়ে!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন রামপ্রসাদ তেওয়ারি৷
মোহন যাদব থমকে দাঁড়াল৷
‘এ শিবজীর চেলা৷ শিবজী আমাদের সঙ্গে আছে৷ কোনও ভয় নেই৷’ বলে রামপ্রসাদ সাপটার কাছাকাছি এগিয়ে গেলেন৷ কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে দিলেন সরীসৃপটার গায়ে৷ আর আশ্চর্য! সাপটাও সড়সড় করে দেওয়ালের একটা বড় ফাটলে ঢুকে পড়ল৷
আবার সব চুপচাপ৷ শুধু আমাদের শ্বাস নেওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ তারই মধ্যে দূর থেকে ভেসে এল অনেকগুলো টিয়াপাখির ডাক—খোলা আকাশে টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে৷
টর্চের আলোয় অন্ধকার ঠেলে-ঠেলে সরিয়ে আমরা আর-একটা ঘরে ঢুকলাম৷ সেই ঘরেরও আধপোড়া ছন্নছাড়া দশা৷ আর তীব্র পোড়া গন্ধটা আমাদের নাকে লেগেই রইল৷
পণ্ডিতজী যখন শান্তির জল ছেটাচ্ছেন তখন হঠাৎই আমি একটা হালকা শব্দ পেলাম৷ শ্বাস-প্রশ্বাসের ফোঁসফোঁস শব্দ৷ আবার৷
শব্দটা যে বাকি তিনজনেও পেয়েছে সেটা বোঝা গেল ওদের টর্চের আলোর ঘোরাঘুরি দেখে৷ ওরা আবার কোনও সাপের খোঁজ করছে৷ আমিও আমার টর্চ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সাপের খোঁজ করতে লাগলাম৷
কিন্তু কোনও সাপই এবার আমরা খুঁজে পেলাম না৷ শুধু দুটো বড়-বড় মেঠো ইঁদুরকে ছুটে পালাতে দেখলাম৷
একটু পরে বুঝলাম, শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা আমাদের খুব কাছে হচ্ছে৷ বলতে গেলে শব্দটা প্রায় আমাদের ঘিরে রেখেছে৷
শুধু তাই নয়, শব্দটা মনে হচ্ছে অনেকের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ—একই ছন্দে, একই তালে শব্দটা ওঠা-নামা করছে৷ এবং সেই ছন্দ আর তাল মিলিয়ে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা আমাদের গায়ে এসে লাগছে৷
আমি ছাড়া বাকিদের গায়েও যে ওই কুবাতাস লাগছিল সেটা বোঝা গেল ওদের কথায়৷
মোহন খানিকটা বিহ্বল গলায় বলল, ‘মাস্টার সাব, একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগছে, টের পাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, টের পাচ্ছি—৷’
‘এটা কীসের বাতাস? কোথা থেকে আসছে?’ মহাবীর যাদব প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন৷
কী উত্তর দেব এসব প্রশ্নের! আমার মনে হচ্ছিল, অনেক অশরীরী যেন আমাদের খুব কাছে এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে৷ তারপর…৷
রামপ্রসাদ তেওয়ারি বোধহয় ভয় তাড়ানোর জন্যেই ‘জয় শিবশম্ভু!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন৷ তার প্রতিধ্বনি শোনা গেল কয়েকবার৷
ঠিক তখনই লোহার সঙ্গে লোহার সংঘর্ষের শব্দ পেলাম: ‘ঘটাং! ঘটাং!’
আমরা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেলাম৷ কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না৷
মোহন যাদব ভয়ের গলায় বলে উঠল, ‘মাস্টারসাব, কোই গড়বড়ি হো রহা হ্যায়৷ আমার তো কেমন লাগছে—৷’
আমি ওকে ভরসা দিয়ে বললাম, ‘ভয় পেয়ো না, মোহন—সব ঠিক আছে৷’
পোড়া গন্ধটা এমনভাবে আমাদের নাকে আসতে লাগল যে, মনে হল, আমাদের চারপাশে যেন আগুন লেগেছে—শুধু তাপ-উত্তাপের ব্যাপারটাই আমরা যা টের পাচ্ছি না৷
অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে-ফেলে একতলার আরও দুটো ঘরে মন্ত্র পড়ে শান্তির জল ছেটানো হল৷ তার মধ্যে একটা ঘর যথেষ্ট বড়, আর সেই ঘরে অনেকগুলো জং ধরা তোবড়ানো লোহার খাট দেখে মনে হল ঘরটা হসপিটালের কোনও ওয়ার্ড—মানে রুগিদের ঘর৷ সেই ঘরটায় কমণ্ডলুর জল ছেটানোর সময় একটা ডানাভাঙা গোলা পায়রা চোখে পড়ল৷ গায়ে টর্চের আলো পড়তেই পায়রাটা শরীর টেনে-টেনে একটা খাটের তলায় অন্ধকারে ঢুকে গেল৷
একটু এগোতেই দেখলাম, একটা দেওয়ালের কোণে অনেক পায়রার পালক ছড়িয়ে রয়েছে৷
মহাবীরজী ‘ইস-স’ বলে উঠলেন৷ তারপর চাপা গলায় আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘পমেশজী, দিনের বেলা এ-বাড়িটায় এত অন্ধকার কেন?’
আমি বললাম, ‘দাগি বিল্ডিং—তার মরজি সে-ই জানে৷’ একটু ঠাট্টা করার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু অন্ধকারের এই বিচিত্র ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল৷
‘ঘটাং! ঘটাং!’ শব্দটা আবার শুনতে পেলাম৷
‘কোথায় আওয়াজ হচ্ছে?’ মোহন যাদব৷
‘লিফটে আওয়াজ হচ্ছে নাকি?’ মহাবীর যাদব৷
‘চলুন—লিফটের কাছে গিয়ে দেখি…৷’ আমি৷
‘জয় শিবশম্ভু! চলিয়ে, লিফট কা পাস চলিয়ে৷ ইধর কা কাম হো গয়া—৷’ রামপ্রসাদ তেওয়ারি৷
আমরা সবাই লিফটের দিকে এগোলাম৷ মহাবীর যাদব টর্চের আলোয় পথ দেখাতে লাগলেন৷ বললেন, ‘আমার পেছন-পেছন আসুন…৷’
হোঁচট খেয়ে, ঠোকর খেয়ে আমরা আন্দাজে লিফটের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম৷ অবাক হয়ে দেখলাম, অন্ধকারের মধ্যে এক জায়গায় লাল আলো জ্বলছে৷ সেই আলো দিয়ে আঁকা রয়েছে একটা তিরচিহ্ন, আর একটা ইংরেজি সংখ্যা ‘চার’৷ তার মানে লিফটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা৷
টর্চের আলো সামনে ফেলতেই লিফটটা বেশ স্পষ্ট হল৷
লিফট তো নয়, এক প্রকাণ্ড লোহার খাঁচা৷ একটু আগের ‘ঘটাং! ঘটাং!’ শব্দ কি লিফটটা থেকেই হচ্ছিল? কিন্তু কী করে হবে? বিনা কারেন্টে লিফট নড়বে কেমন করে?
ঠিক তখনই মহাবীরজী অবাক হয়ে বললেন, ‘বিনা বিজলিতে এই লাল বাত্তি জ্বলছে কেমন করে?’