এই কাজে আমাদের সঙ্গে মোহন যাদবের থাকাটা ওর বৃদ্ধ মা-বাবা মোটেই পছন্দ করেননি—এমনকী ওঁরা অনেক কান্নাকাটিও করেছেন৷ কিন্তু মোহন ওর জেদে অনড়—আমাদের সঙ্গে জোট বেঁধে ‘দাওয়াই টাউন’-এর একটা এসপার-ওসপার ব্যবস্থা ও করবেই৷ এতে আমার মনে হয়েছে, গালের ওই কাটা দাগটার বদলা নেওয়ার এই সুযোগ ও ছাড়বে না৷
মোহনের গায়ে রুলটানা বাদামি ফতুয়া আর একটা কালো রঙের হাফপ্যান্ট৷ প্যান্টের পকেটে রয়েছে টর্চ৷ হাতে ফুটচারেক লম্বা একটা লোহার রড৷ চোয়াল শক্ত, নজর সতর্ক৷
মহাবীর যাদব পরেছেন মালকোঁচা মেরে ধুতি, আর তার ওপরে হাফহাতা শার্ট৷ আমি পরেছি সাধারণ বুশ শার্ট আর প্যান্ট৷
আমরা দুজনও নিরস্ত্র নই৷ আমাদের দুজনেরই হাতে রয়েছে শক্তপোক্ত বাঁশের লাঠি৷ এ ছাড়া আমরাও টর্চ রেখেছি সঙ্গে৷ মোহনের কাহিনি শোনার পর আমার মনে হয়েছিল, বিল্ডিং-এর ভেতরের ওই অদ্ভুত অন্ধকারের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে আমরা চারজনই সঙ্গে টর্চ রাখব৷ এ-কথা আমি মিটিং-এর সময় বলেছিলাম৷ তাই চারটে মাঝারি মাপের টর্চ আমরা কিনেছি৷
আমাদের এই অভিযানের জন্যে এ পর্যন্ত যা-যা খরচ হয়েছে তার সবটাই মহাবীর যাদব সামলেছেন৷ তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, বদ্রীনাথ মিশ্রর কাছ থেকে যে টাকা তিনি পেয়েছেন এই কাজের সমস্ত খরচ তিনি সেই টাকা থেকেই চালাবেন৷ এই সিদ্ধান্ত আমরা সবাই মেনে নিয়েছি৷
পণ্ডিতজীর মন্ত্র পড়ে বিল্ডিং প্রদক্ষিণের কাজ শেষ হলে আমরা বিল্ডিং-এর দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম৷
আমি হাতঘড়ির দিকে তাকালাম: চারটে বেজে পাঁচ মিনিট৷
তারপর মুখ তুললাম আকাশের দিকে৷ মনে হল যেন, মেঘের স্তর একটু বেশি গাঢ় হয়েছে৷ ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না৷
পণ্ডিতজী বিল্ডিং-এর দরজায় কমণ্ডলু থেকে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেন৷ বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন৷ হাতের ত্রিশূলটা প্রথমে নিজের কপালে ঠেকিয়ে তারপর একে-একে আমাদের তিনজনের কপালে ঠেকালেন৷ প্রত্যেকবার ঠেকানোর সঙ্গে-সঙ্গে চাপা গলায় বললেন, ‘জয় শিবশম্ভু! জয় ভূতনাথ!’
তারপর আমাদের বললেন, ‘অব অন্দর চলিয়ে৷ ডরনেকি কোই বাত নহি৷ ভোলেনাথজী খুদ হামারে সাথ হ্যায়৷ জয় বাবা ভোলেনাথ!’
আমরা চারজনে সাবধানে পা ফেলে অভিশপ্ত বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লাম৷ ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে মহাবীর যাদব ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন৷ তারপর জড়ানো গলায় দু’বার ডুকরে উঠলেন, ‘লছমি! লছমি!’
আমি মহাবীরজীর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ ওঁর কাঁধে হাত রেখে সামান্য চাপ দিয়ে আলতো করে বললাম, ‘মহাবীরজী, আপনে দর্দকো কাবুমে রাখিয়ে…৷’ টের পেলাম, মহাবীর যাদবের শরীর থরথর করে কাঁপছে৷
দাগি বিল্ডিংটার ভেতরে ঢোকামাত্রই যে ব্যাপারটা আমাদের প্রথম ধাক্কা মারল, সেটা হল অন্ধকার৷
যেদিকে তাকাই সেদিকেই চাপ-চাপ অন্ধকার৷ মোহনের কথা মিলে যাচ্ছে অক্ষরে-অক্ষরে৷
রামপ্রসাদ তেওয়ারি আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, ‘জয়-জয় শিবশম্ভু!’
আমি চমকে উঠলাম৷ মহাবীর আর মোহনও বোধহয় চমকে উঠেছিল—অন্ধকারে ঠিক ঠাহর হল না৷ তেওয়ারিজীর চিৎকারের প্রতিধ্বনি ঘুরতে লাগল বাড়ির আনাচে-কানাচে৷
রামপ্রসাদজীর চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে ঝটাপটির শব্দ শোনা গেল৷ তারপর ডানার পতপত শব্দ৷ যেন অনেকগুলো পাখি দিশেহারা হয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে৷ দরজা আর জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে কয়েকটা কালো-কালো পাখিকে উড়ে যেতেও দেখলাম৷
রামপ্রসাদজী বললেন, ‘সবাই টর্চ জ্বালুন৷ একতলার ঘরগুলোয় শান্তির জল ছিটিয়ে ত্রিশূল ঠেকিয়ে পবিত্র করতে হবে…৷’
আমরা চারজনেই প্রায় একসঙ্গে টর্চের আলো জ্বাললাম৷ তখনই মনে হল, কারা যেন আলোর বৃত্ত থেকে একলাফে ছিটকে সরে গেল গাঢ় অন্ধকারে৷
মেঝেতে টর্চের আলো ফেলে আমরা কোনওরকমে এগিয়ে চললাম৷ মেঝেতে পড়ে আছে অজস্র পোড়া কাগজ, পুড়ে যাওয়া পরদার অংশ, তুবড়ে যাওয়া লোহার বালতি, বাটি, গ্লাস আর লোহার পাইপ৷ সেসব ডিঙিয়ে খুব সাবধানে পা ফেলে আমরা প্রথম ঘরটায় ঢুকলাম৷
ঘরটা আগুনে পুড়েও যেন পোড়েনি৷ দেওয়ালগুলো ভাঙাচোরা, ফাটল ধরা৷ সব জায়গায় ভুসোকালির ছোপ৷ তার ওপরে ধুলোর স্তর পড়েছে, দেওয়ালের কোণে মাকড়সা জাল বুনেছে৷ আর ঘরের এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা চেয়ার-টেবিল৷
এক কোণে একটা আলমারি৷ তার পাশে দেওয়ালের ব্র্যাকেটে ঝুলছে কয়েকটা আধপোড়া পোশাক৷ তার নীচে মেঝেতে পড়ে আছে দুটো স্টেথোস্কোপ৷ তাদের রবারের পাইপ গলে গেছে৷
হঠাৎ পোড়া গন্ধের ঝাপটা নাকে এল৷
অবাক হয়ে গেলাম৷ এত বছর পরেও এই পোড়া গন্ধ!
মহাবীর যাদব বললেন, ‘তাজ্জব ব্যাপার!’
মোহন যাদব বলল, ‘মাস্টারজী, আমি কিন্তু পোড়া গন্ধ পাইনি৷’
আমরা সবাই নীচু গলায় কথা বলছিলাম৷
রামপ্রসাদজী ওঁর মন্ত্র পড়া থামাননি৷ ওঁর স্বর সাগরের ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করছিল৷ টর্চের বিক্ষিপ্ত আলোয় দেখলাম, ওঁর বাঁ-হাতে কমণ্ডলু এবং টর্চ৷ ডান হাতে ত্রিশূল৷ সেই অবস্থাতেই মন্ত্র পড়তে-পড়তে শান্তির জল ছিটিয়ে চলেছেন৷
আমাদের চারটে টর্চ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে আলোর আঁকিবুকি কাটছিল৷ সেই আলোর আভায় দেখলাম, মহাবীরজী মাঝে-মাঝেই শার্টের খুঁট দিয়ে চোখ মুছছেন৷
হঠাৎই কানে এল এক অদ্ভুত শব্দ৷ জোরে-জোরে কেউ যেন শ্বাস নিচ্ছে৷ অনেকটা সাপের ফোঁসফোঁস শব্দের মতো৷