মোহন ভয় পেয়ে গেল৷ চুরির লোভ পলকে মুছে গেল ওর মন থেকে৷ ওর মন তখন একটাই কথা বলছিল: ‘পালাও! পালাও!’
কিন্তু পালাবে কোনদিকে? দরজাটা যে ঠিক কোনদিকে সেটাই মোহনের গুলিয়ে গেছে৷
গর্জনটা শোনা গেল আবার৷ খুব চাপা৷ যেন একটা মোটরগাড়ির ইঞ্জিন ধিকিধিকি চলছে৷
মোহন উঠে দাঁড়াল৷ কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই পিঠের ব্যথাটা যেন বর্শার মতো বিঁধল৷ এদিক-ওদিক নজর চালিয়ে মোহন পাগলের মতো দরজাটা খুঁজতে লাগল৷ কোথায় দরজাটা? কোথায়?
গর্জনটা হঠাৎ বেড়ে উঠল৷ একটা ক্ষিপ্ত পশু যেন তেড়ে আসবে এখুনি৷ এই পোড়ো বিল্ডিংটায় কোনও পশু কি এসে আস্তানা গেড়েছে?
মোহনের সন্ধানী চোখ দরজাটা এবার খুঁজে পেল৷ ওই তো, আধভাঙা পাল্লার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আলো দেখা যাচ্ছে!
ও সেদিকে পা বাড়াতেই গর্জনটা বেড়ে উঠল৷ লোহায়-লোহায় ঠোকাঠুকির শব্দ হল ‘খটাং-খটাং’৷ আর কী যেন একটা বিদ্যুৎঝলকের মতো মোহনের গাল ছুঁয়ে গেল৷
তারপরই অসহ্য জ্বালা৷ গালে হাত চলে গেল ওর৷ গাল ভিজে, চটচট করছে৷
সেই হাত চোখের সামনে নিয়ে এসে কিছু দেখা না গেলেও ও বুঝতে পারল ওর হাত রক্তে ভেজা৷ ওর গাল আর গলা গড়িয়ে রক্ত পড়ছে৷ সেই সঙ্গে তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণা৷ বুক ধকধক করছে৷ গলা শুকিয়ে কাঠ৷
গালে হাত চেপে মোহন পাগলের মতো ছুটে যেতে চাইল দরজার দিকে৷ গাঢ় অন্ধকারে দরজার জ্যামিতিক চেহারার আলোর টুকরোটা যেন দিশাহীন সাগরে এক লাইট হাউস৷ কিন্তু ছুটে পালাতে গিয়ে কতবার যে হোঁচট খেল, উলটে পড়ল!
পা কেটে গেল কত জায়গায়, হাঁটু ছড়ে গেল, কিন্তু মোহন তাড়া খাওয়া নেড়ি কুকুরের মতো পৌঁছে গেল বিল্ডিং-এর দরজায়৷
তারপর গালে হাত চেপে বিল্ডিং-এর বাইরে৷
তখনও আকাশে বেশ আলো৷ সেই আকাশ আর গাছপালার দিকে তাকিয়ে আনন্দে কয়েকটা বড়-বড় শ্বাস নিয়েছিল ও৷ এখন ও বুঝতে পারছে, জীবন কত দামি! শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারাটা ওপরওয়ালার কত বড় আশীর্বাদ!
তারপর মোহন পাশের মহল্লায় ওর একজন চেনা কম্পাউন্ডার সত্যদেও দুবেকে দিয়ে গালের কাটা-ছেঁড়ার ট্রিটমেন্ট করায়৷ দুবেজী ওঁর সাধ্যমতো ট্রিটমেন্ট করলেও বীভৎস কাটা দাগটা থেকেই গেছে৷
ওর কাহিনি শেষ করে মোহন যাদব একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘মাস্টারজী, সবই আমার নসিব…৷’
আমি মোহনের গল্পটা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম৷ কেন জানি না মনে হল, যে-কাজে আমরা চারজন এগোচ্ছি সেই কাজটা খুব একটা সহজ হবে না৷
মোহনকে শুধু বললাম, ‘পরশু রাত আটটার সময় আমরা চারজন মিটিং-এ বসব৷ ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ রওনা হওয়ার আগে কয়েকটা ব্যাপার আমাদের নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে নেওয়া জরুরি৷ তুমি ঠিক আটটায় আমার ঘরে চলে আসবে৷’
মোহন ঘাড় কাত করল৷ তারপর আমাকে নমস্কার জানিয়ে চলে গেল৷ আমি অকারণেই ওর গালের কাটা দাগটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম৷
আজ ফাল্গুনী—মানে, বাসন্তী পূর্ণিমা৷
আমাদের পণ্ডিতজী রামপ্রসাদ তিওয়ারি আজকের দিনটাকেই অভিযানের পক্ষে মানানসই দিন বলে ঠিক করেছেন৷ আরও বলেছেন, বিকেল তিনটে একচল্লিশ মিনিট গতে শুভ সময়ের শুরু৷ তাই আমরা চারজনে সাড়ে তিনটের সময় ‘দাওয়াই টাউন’-এ এসে হাজির হয়েছি৷
রামপ্রসাদজী প্রথমে বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়লেন৷ তারপর কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘জয়-জয় শিবশম্ভু! হর হর মহাদেও!’
রামপ্রসাদজীর পরনে গেরুয়া৷ বাঁ-হাতে একটা বড় কমণ্ডলু, ডানহাতে একটা ছোট ত্রিশূল৷ কপালে চন্দন লেপা, টিকিতে বাঁধা আকন্দ ফুল৷ এ ছাড়া কোমরে গোঁজা রয়েছে টর্চ৷
মানুষটা রোগাসোগা হলে কী হবে, ওঁর সাহসের রীতিমতো প্রশংসা করতে হয়৷ সেই শুরু থেকেই বলে আসছেন, ‘আমার দেওতা শিবশম্ভুর চেয়ে শক্তিমান এই ত্রিভুবনে কেউ নেই৷ ভূতপিরেত সব আমার ভোলেনাথজীর নওকর৷ ওই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ যত ভূত-জিন আছে সব শিবশম্ভুর নামে ভেগে যাবে৷ যারা যাবে না, তাদের ভোলেনাথজীর এই ত্রিশূল খতম করবে—’ বলে হাতের ত্রিশূলটাকে মাথার ওপরে উঁচিয়ে ধরেছেন পণ্ডিতজী৷
রামপ্রসাদজীর সাহস দেখে আমরা তিনজনে মনে খানিকটা সাহস পাচ্ছিলাম৷ তা ছাড়া পণ্ডিতজী আজকের এই অভিযানের জন্যে মন্দিরে দু-ঘণ্টার যজ্ঞ করেছেন৷ যজ্ঞের পর তিনি মহাদেবের মনের কথা শুনতে পেয়েছেন: আমাদের অভিযান সফল হবেই৷
বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্রোচ্চারণের পর পণ্ডিতজী গোটা বিল্ডিংটাকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করলেন৷ মন্ত্র বিড়বিড় করতে-করতে কমণ্ডলুর জল ছেটাতে লাগলেন৷ মন্ত্রের মধ্যে শুধু ‘জয়-জয় শিবশম্ভু’ অংশটুকু আমি বুঝতে পারছিলাম৷ পণ্ডিতজীর পেছন-পেছন আমরা তিনজনও বিল্ডিংটাকে ঘিরে হাঁটছিলাম৷
আকাশে মেঘ, তাই চারপাশটা কেমন গুমোট৷ একটা ফ্যাকাশে ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে৷ গোটা এলাকাটা কেমন নিঝঝুম চুপচাপ৷ কাছে-দূরে যেসব গাছপালা দেখা যাচ্ছে তাদের একটি পাতাও নড়ছে না৷ মনে হচ্ছে, ওরা দম বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখছে৷
ওরা ছাড়া আর কোনও দর্শক নেই—যদি দু-চারটে কাক, শালিখ, বুলবুল কিংবা ফিঙেকে আমরা হিসেবের মধ্যে না ধরি৷ যাদবদের মহল্লা আর তার আশপাশে মহাবীরজী আর রামপ্রসাদজী অনেক আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘দাওয়াই টাউন’-এর শান্তি-স্বস্ত্যয়নের সময় আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ হাজির থাকলে সমস্ত কাজ পণ্ড হয়ে যাবে৷ তাই কৌতূহল থাকলেও কেউ আসেনি৷