কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর মোহন ঘাড় কাত করে জানাল, ও আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি৷
আমি এবার আচমকা প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার গলায় আর গালে এরকম বাজেভাবে কেটে গেল কেমন করে?’
মোহন কেমন থতমত খেয়ে গেল৷ তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘ছোড়িয়ে, মাস্টারজী৷ মেরা নসিব—৷’
হ্যারিকেনের আলো মোহনের গলায়, গালে আর থুতনিতে পড়েছিল৷ সেই অল্প আলোতেও কাটা দাগটা বীভৎস দেখাচ্ছিল৷ আর ওর মুখে যে একটা ভয়ের পরত নেমে এল, সেটাও বোঝা গেল৷
মোহন চুপ করে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল৷
‘মোহন, প্লিজ বলো৷ শংকর শম্ভুর কসম, তোমার এসব কথা আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না—কেউ না৷’
মোহন চুপ করে রইল৷
আমি মোহনকে বোঝাতে লাগলাম, আর বোঝাতে লাগলাম৷ বললাম যে, ওর ঘটনাটা জানতে পারলে ‘দাওয়াই টাউন’-এ যখন আমরা চারজন যাব তখন আমাদের কাজের সুবিধে হবে৷ মোহন কি চায় না, ‘দাওয়াই টাউন’ পুরো সাফ হয়ে গিয়ে সেখানে কলকারখানা তৈরি হোক?
বেশ কিছুক্ষণ পর মোহন যাদব আপনমনে ঘাড় নাড়ল৷ বিড়বিড় করে বলল, ‘হাঁ, মাস্টারজী—আপনি যেসব ফ্যাক্টরি-উক্টরির কথা বলছেন সেসব আমিও চাই৷ আমিও চাই যে, আমি দু-চার পয়সা কামাই—মহল্লার লোকজনের কাছ থেকে একটু ইজ্জত পাই৷ লেকিন…৷’
‘ওসব লেকিন-টেকিন শুনব না, মোহন—বলো…৷’ আমার কীরকম যেন একটা জেদ চেপে গিয়েছিল৷
মোহন গ্লাস থেকে ঢকঢক করে জল খেল৷ গ্লাসটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে হাত দিয়ে মুখ মুছল৷ তারপর কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বলছি, তবে সিরফ আপনার জন্যে৷ সুনেন, মাস্টারসাব, ও অস্পাতালে অনেক খারাপ জিন আছে…৷’
আমি আবার মোহনকে কথা দিলাম, ওর এই কাহিনি আমি কাউকে বলব না৷
প্রায় একবছর আগে মোহন ‘দাওয়াই টাউন’-এ ঢুকেছিল চুরি করতে৷ ও ছোকরু আর মুন্নার মার্ডারের ব্যাপারটা জানত৷ সেজন্যে মনে ওর ভয়ও ছিল৷ কিন্তু অভাব বড় বালাই৷ গান-টান গেয়ে প্রচুর তারিফ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু পয়সা পাওয়া যায় না৷ জোয়ান ছেলে হয়েও ও কোনও কাম-কাজ জোটাতে পারেনি, সেটাই ওর সবচেয়ে বড় অপরাধ৷ তার তুলনায় চোরি আর কী এমন বুরা কাম!
নানান লোকের কাছে মোহন শুনেছিল যে, ‘দাওয়াই টাউন’-এর ওই বিশাল বিল্ডিংটার ভেতরে অনেক দামি-দামি সামান আছে৷ বেঞ্চি, টেবিল, খাটিয়া ইত্যাদি হরেক ফার্নিচার থেকে শুরু করে প্রচুর ডাক্তারি যন্ত্রপাতি এখানে-সেখানে পড়ে আছে৷ এ ছাড়া কপাল ভালো থাকলে ওই অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া লোকজনের পোড়া গয়নার টুকরোটাকরাও মিলে যেতে পারে৷
‘তো একদিন দুপুরে আমি সবার চোখ এড়িয়ে ওই দাগি বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়ি৷ আপনার কাছে কবুল করছি যে, ছোটা-মোটা চোরি-ওরির অভ্যাস আমার বেশিদিন নয়—মাত্র পাঁচ-সাত বছরের৷ কী করব! পাপী পেট কা সওয়াল৷
‘চোরাই মাল উঠিয়ে আনার জন্যে আমার হাতে একটা বোরা ছিল৷ বোরা, মানে বস্তা৷ সেটা নিয়ে আমি তো সাফ ওই বিল্ডিং-এ ঢুকে গেলাম৷ উসকে বাদ…৷’
বিল্ডিংটায় ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে মোহন যাদবের নাকে এসেছিল পোড়া গন্ধ৷ আর একইসঙ্গে একটা অদ্ভুত জিনিস ও লক্ষ করেছিল: বিল্ডিং-এর ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ এটা মোহনের অবাক লেগেছিল, কারণ, ও দেখতে পেল, একতলার তিনটে জানলায় একটা করে পাল্লা নেই—কোনওটা খসে গেছে, আবার কোনওটা কবজা ভেঙে ঝুলে গেছে৷
সেইসব আধখোলা জানলা দিয়ে ঘরগুলোতে আলো ঢোকার কথা, অথচ সেরকম কোনও আলো চোখে পড়েনি ওর৷ চারপাশটা যেন মনে হচ্ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ আর সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে বিচিত্র সব ধাতব শব্দ আসছে৷ অথচ মোহন যখন বিল্ডিংটায় ঢোকে তখন এই শব্দগুলো ছিল না৷
মোহন অন্ধের মতো হাতড়ে-হাতড়ে কোনওরকমে চলাফেরার চেষ্টা করছিল৷ দু’বার হোঁচট খেয়ে পড়েও গেল৷ পড়ল লোহালক্কড়ের টুকরোর ওপরে৷ হাত-পা কয়েক জায়গায় কেটে-ছড়ে গেল৷ জ্বালা করতে লাগল৷ ওই অবস্থাতেই ও দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগল৷ কোনদিকে সিঁড়িটা? অন্ধকারে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না! একটা টর্চ সঙ্গে নিয়ে এলে খুব ভালো হত৷
অন্ধকারে হাতড়ে দু-চারটে লোহার টুকরো কুড়িয়ে নিল ও৷ বস্তার মধ্যে ঢোকাল৷ কিন্তু এগুলো বেচে আর ক’পয়সা হবে! হতাশ মোহন হঠাৎ দেখতে পেল, অন্ধকারে দুটো ছোট-ছোট আলো জ্বলছে—দুটোই লাল রঙের! একটা আলো তিরচিহ্নের মতো৷ আর তার ঠিক ওপরে একটা আলো ইংরেজিতে ‘চার’ সংখ্যাটা দেখাচ্ছে৷
আলোটা মোহনকে টানছিল৷ টানটা জোরালো কোনও চুম্বকের চেয়েও তীব্র৷ ভালো-মন্দ কিছু ভেবে ওঠার আগেই মোহনের পা চলতে শুরু করে দিয়েছিল৷ ভাঙাচোরা জিনিসের টুকরোটাকরা মাড়িয়ে, ঠোক্কর খেয়ে, হোঁচট খেয়ে মোহন সেই তিরচিহ্ন অথবা ‘চার’ সংখ্যাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল৷ ওর মাথায় কেমন যেন ঘোর লেগে গিয়েছিল৷ মনে হচ্ছিল, ওই লাল আলোর কাছে ওর যাওয়া চাই—ওটাকে ছোঁওয়া চাই৷
এইরকম একটা সময়ে ওর পিঠে কেউ যেন এক প্রচণ্ড আঘাত করল৷ মনে হল, একটা ভারী লাঠি অথবা লোহার রড কেউ বসিয়ে দিয়েছে পিঠে৷ মোহন মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে৷ যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল৷ ওর নাকে-মুখে ধুলো-ময়লা ঢুকে গেল৷ বস্তাটা ছিটকে গেল হাত থেকে৷
ও কোনওরকমে উঠে বসল৷ পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা৷ চারিদিকে তাকিয়ে লাল আলোয় লেখা তিরচিহ্ন অথবা সংখ্যাটাকে দেখতে পেল না৷ একটা চাপা গর্জন ওর কানে এল৷ চিতাবাঘ, নাকি নেকড়ের গর্জন?