দেখা গেল, অনেক বাঁশের জটলার মধ্যে ছেলেটা একটা বাঁশ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মাথাটা নীচের দিকে ঝুঁকে আছে৷ থরথর করে কাঁপছে৷
লোকজন অন্ধকারে বেশি কাছে এগোতে সাহস পেল না৷ কে জানে, ছেলেটার সঙ্গে কী না কী অস্ত্র আছে! তাই একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা চেঁচামেচি করতে লাগল, নানান হুমকি দিতে লাগল৷ আবার কেউ-কেউ ঢিল ছুড়তে লাগল৷
ব্যাপারটা সোমপ্রকাশের ভালো লাগছিল না৷
অথচ চোরকে তাড়া করে বেড়ানোর এই আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট সময়ের মধ্যে দুবার কি তিনবার ওঁর মনে হয়েছিল, হাতের ক্রিকেট ব্যাটটা চোরকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারেন৷
এখন সে-কথা মনে পড়ে ওঁর খারাপ লাগল৷
চারপাশে অন্ধকার আর শীত৷ বাঁশবাগানের এখানে-ওখানে কুয়াশা দিয়ে তৈরি হাওয়ামিঠাই ভাসছে৷ আকাশে ফ্যাকাশে সরু চাঁদ৷
সোমপ্রকাশ ছোট-ছোট ছেলেদের ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে বড়-বড় লোকদের দেখছিলেন৷ বাবা, মেজকাকা, ছোটকাকা, সমীর-কাকু, ঠাকুরমশাই, মিত্যুনকাকু, হূদয়দা, রঘুদা—এ ছাড়া আরও অনেক চেনা-অচেনা মুখ৷ তাদেরই কেউ-কেউ চোরকে লক্ষ্য করে হুঙ্কার ছাড়ছে৷
‘এই ছোঁড়া, বেরিয়ে আয়—বেরিয়ে আয় বলছি!’
‘ফাঁড়িতে একটা খবর দিলে হয় না? পুলিশের ডান্ডা খেলে ব্যাটা সিধে হয়ে যাবে…!’
‘এই শীতে ওর কষ্ট হচ্ছে না?’ কে একজন প্রশ্ন করল—যে-প্রশ্নটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল৷
উত্তরে আর-একজন দুরছাই ঢঙে জবাব দিল, ‘হুঁ! চোরদের আবার শীত! দেখলেন না, পুকুরের ঠান্ডা জলে সাঁতরে দিব্যি উঠে এল!’
‘টাকার প্যাকেটটা উঁচু করে ধরে রেখেছিল—যাতে জলে না ভেজে৷’
‘বাঁশঝাড়ের মধ্যে কেমন নিশ্চিন্তে ঘাপটি মেরে আছে—ব্যাটার সাপখোপের ভয়ও নেই৷’
‘এই শীতে সাপ আর কোথায়! সব তো গর্তে সেঁধিয়ে আছে…৷’
‘অ্যাই, বেরো—বেরিয়ে আয়! চুপচাপ যদি বেরিয়ে আসিস তা হলে কিচ্ছু বলব না৷ আয়, বেরিয়ে আয়…৷’
কিন্তু এসব কথায় চোর ছেলেটা তেমন কর্ণপাত করল বলে মনে হল না৷ বাঁশ আঁকড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়েই রইল—যেন একটা পাথরের মূর্তি৷ তবে ওর শরীরটা উঁচু কম্পাঙ্কে কাঁপছিল৷
রাত ক্রমে বাড়ছিল৷ বড়রা নিজেদের মধ্যে নানান আলোচনা করছিল৷ আলোচনার মূল বিষয় ছিল: এখন কী করা যায়? এভাবে তো আর সারারাত দাঁড়িয়ে থাকা যায় না৷
বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর ঠিক হল, ছ’জন এই বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে পাহারা দেবে৷ এবং পালা করে এই পাহারা চলবে ভোর পর্যন্ত৷ তারপর সকালবেলা চোরটাকে টেনে বের করে একটা হেস্তনেস্ত করা হবে৷ মিত্যুনবাবুর টাকাটা যে করে হোক উদ্ধার করতে হবে৷
ব্যস, লাঠিসোঁটা নিয়ে ছ’জন জোয়ান বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ খোলা জায়গায় শীত ঠেকানোর জন্য কয়েকজন তাদের চাদর-শাল ইত্যাদি ওই ছ’জনকে ধার দিলেন৷ কোন দলের পর কোন দল পাহারা দেবে সেসব আলোচনাও করে নিল বড়রা৷ তারপর সবাই ফেরার পথ ধরল৷
সোমপ্রকাশও বাবা-কাকার নজর এড়িয়ে বাড়ির পথ ধরেছিলেন৷ অন্ধকার রাস্তা ধরে ছুটে যাওয়ার সময় ঝিঁঝিঁর শব্দ কানে এসেছিল, আর কয়েক ঝাঁক জোনাকির সঙ্গে সোমের দেখা হয়েছিল৷
বাড়ি ফিরে মা-কে প্রথমে ম্যানেজ করেছিলেন সোমপ্রকাশ৷ চোর ধরার রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প মা-কে শুনিয়েছিলেন৷ তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন—কারণ, কাল ভোরবেলা তো আবার ওই বাঁশবাগানে যেতে হবে!
চোখ বুজে শুয়ে থাকলেও বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা চোরের ছবিটা সোম যেন দেখতে পাচ্ছিলেন৷ ছবিটা কিছুতেই সরতে চাইছিল না৷
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় সোমপ্রকাশের আবার এক অ্যাডভেঞ্চার৷
বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই সোম চুপিসাড়ে তৈরি হলেন৷ তারপর ঘুমন্ত মা-কে ফাঁকি দিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে৷
ভোরের কুয়াশা সরিয়ে সোম বাঁশবাগানের দিকে চললেন৷ অন্ধকার সবে ফিকে হতে শুরু করেছে৷ আলো ফুটছে আকাশে৷ কিন্তু আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ মাঝ-আকাশ থেকে বেশ খানিকটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে৷
ভোরের শীত ঠেকাতে সোয়েটারের ওপরে মায়ের একটা শাল জড়িয়ে নিয়েছেন সোম৷
বাঁশবাগানের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ কাল রাতের বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে প্রায় বারো-চোদ্দোজন লোক জড়ো হয়ে গেছে৷ হাতে লাঠিসোঁটা আর টর্চ৷ কিন্তু সেখানে কোনও ছোট ছেলে নেই৷
দৃশ্যটা সোমপ্রকাশের মনে চিরকাল বেঁচে থাকবে৷
বাঁশবাগানের মাথার ওপরে বাঁকা চাঁদ৷ চারপাশ ঠান্ডা, শান্ত৷ অসংখ্য বাঁশঝাড় কাছাকাছি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে—যেন সব ভাই-ভাই৷ তারই একটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে চোর-শিকারির দল৷
বাবার নজর এড়াতে আসল বাঁশঝাড়টার পাশের একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন সোম৷ বাঁশের কাটাকুটির ফাঁকফোকর দিয়ে সব দেখতে লাগলেন, শুনতে লাগলেন৷
ভোরের আলো ফুটেছে৷ তার সঙ্গে-সঙ্গে শিকারিদের সাহসও বেড়েছে৷ বাঁশঝাড়টার খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে তারা এখন ছেলেটাকে লাঠির খোঁচাখুঁচি দিচ্ছে৷ শাসাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, এমনকী পিটিয়ে মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে৷
ছেলেটা সেই একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে৷ একটা বাঁশকে জড়িয়ে ধরে আছে৷ শুধু মাথাটা কাল রাতের তুলনায় আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে৷
ছেলেটা এখন আর শীতে কাঁপছে না৷