আমাকে অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থাকতে দেখে মহাবীর জিগ্যেস করলেন, ‘পমেশজী, কী ভাবছেন?’
‘মোহন যাদবের কথা ভাবছি৷ ওকে আমাদের সঙ্গে নিলে হয় না?’
কথাটা বলে মোহনকে সঙ্গে নিতে চাওয়ার কারণটাও খুলে বললাম৷
‘ও যদি রাজি হয় নিতে পারেন৷ আমার তাতে কুছু আপত্তি নেই৷ ছোকরা জোয়ান আছে৷ তা ছাড়া ওর সাহসও আছে—’ আপনমনে ওপর-নীচে মাথা নাড়লেন মহাবীরজী৷ তারপর: ‘আপনি মোহনকে একবার বলে দেখেন৷ আপনি বললে ও হয়তো রাজি হয়ে যাবে৷ ও গেলে খালি হাতে ফিরবে না৷ বদ্রীনাথজীর রুপেয়া থেকে মোহনকে হিস্যা ভি দেব আমি…৷’
মহাবীর যাদবের কথার মধ্যে ‘হিস্যা’ শব্দটা আমার কানে বাজল৷ কিন্তু এটা আমার মনে হচ্ছিল, ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভূতুড়েপনার সত্যি-সত্যি এসপার-ওসপার হওয়া দরকার৷
আমার তখন বয়েস কম ছিল৷ তাই মনের যুক্তিবাদী অংশটা ছিল অনেক জোরালো৷ রাখিতপুরের লোকজন যতই ভূতিয়াঘরের ভূত সম্পর্কে গদগদ বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা দেখাক, আমি বিনা পরীক্ষায় ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নেব না৷ এখন এলাকার তিন-তিনজন মানুষ যখন ‘দাওয়াই টাউন’-এর বদনাম বিল্ডিং-এ অ্যাডভেঞ্চার করতে রাজি, তখন আমার আর দোষ কোথায়? এই সুযোগে ব্যাপারটার শেষ দেখে ছাড়া যাবে৷
আমি মহাবীরজীকে বললাম যে, দু-একদিনের মধ্যেই আমি মোহনের সঙ্গে কথা বলব৷ তারপর আমরা চারজনে—মানে, আমি, মোহন, মহাবীরজী আর রামপ্রসাদ তিওয়ারিজী—নিজেদের মধ্যে একটা গোল মিটিং সেরে নেব৷ মিটিং-এ রামপ্রসাদজী যে-দিনক্ষণ বলবেন আমরা সেই অনুযায়ী ‘দাওয়াই টাউন’-এ অপারেশান চালাব৷
মহাবীর যাদব আমার কথায় ঘন-ঘন ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন৷
বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে৷ যদিও আকাশের ছাই রং আরও গাঢ় হয়েছে৷
একদিন সন্ধেবেলা স্টেশান থেকে ফিরে দেখি মোহন যাদব আমার ঘরের দরজার পাশে একটা ধাপিতে বসে রয়েছে৷
তখন ক’টা বাজে? সাতটা পনেরো কি সাতটা কুড়ি৷
আমি আস্তানার কাছাকাছি আসতেই মোহন উঠে দাঁড়াল৷ আমার কাছে এসে চট করে ঝুঁকে পড়ল আমার পায়ের দিকে৷ হাত বাড়িয়ে দুটো হাঁটু পরপর ছুঁয়ে বলল, ‘পায় লাগু, মাস্টারজী—৷’
আমি ওকে প্রণামে বাধা দেওয়ার সময়ই পেলাম না৷ মহাবীর যাদবের কথা মনে পড়লঃ ‘মোহনের থেকে আপনি কথা বের করতে পারবেন৷ আপনাকে ও বহত রিসপেক্ট করে…৷’ সে-কথার শেষটুকু তো দেখছি সত্যি হল, কিন্তু সামনের অংশটুকু সত্যি হবে কি?
দেখা যাক৷ আজ আমি মোহনকে সোজাসাপটা জিগ্যেস করব৷ কারণ, ‘দাওয়াই টাউন’-এ হানা দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আর দেরি করা যাবে না৷ মহাবীর যাদব, আমি আর পূজারিজী তো তৈরি হয়েই আছি৷ শুধু মোহনের ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ জানতে পারলেই পূজারিজী দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলবেন৷
আমি দরজা খুলতে-খুলতে জিগ্যেস করলাম, ‘সেই যে আসবে বললে, তারপর তো উধাও হয়ে গেলে—!’
মোহন যাদব মাথা নীচু করে অপরাধীর গলায় বলল যে, ওর বাবা হঠাৎ খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাবাকে নিয়ে ও ধানবাদের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিল—আজ সকালেই ফিরেছে৷
‘এসো, ভেতরে এসো—’ ওকে ঘরের ভেতরে ডাকলাম: ‘তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে৷’
দেশলাই বের করে হ্যারিকেন জ্বেলে দিলাম৷ মোহনকে মোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বসতে বললাম৷ একটা তাক থেকে বিস্কুটের কৌটো পেড়ে নিয়ে চারটে বিস্কুট বের করলাম৷ দুটো মোহনকে দিয়ে দুটো আমি নিলাম৷ আমার কাছে অতিথি আপ্যায়নের এ ছাড়া কোনও ব্যবস্থা নেই৷
কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে গ্লাসটা মোহনের মোড়ার পাশে রাখলাম৷
মোহন যাদব কেমন যেন সঙ্কোচ পাচ্ছিল৷ বোধহয় ওর আর আমার জাতের তফাত নিয়ে ভাবছিল৷
জলের গ্লাসটা ওর নাগালে রাখতেই ও বলে উঠল, ‘মাস্টারজী, আপনি এত তকলিফ করছেন কেন? পানি তো ম্যায় খুদ লে সকতা থা—৷’
আমি ওকে স্নেহের ধমক দিলাম: ‘তুমি চুপ করো তো! যত্ত সব! নাও, বিস্কুট খাও—৷’
বিস্কুট খেতে-খেতে মোহন ইতস্তত করে বলল, ‘আপনি উস দিন কলকাত্তায় গানের কথা বলছিলেন…৷’
‘হ্যাঁ৷ এর মধ্যে আমি ট্রাঙ্ক-কল করে আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি৷ সামনের আগস্ট মাসে তুমি কলকাতায় যাচ্ছ—আমার সঙ্গে৷ সেখানে আমার বাড়িতে তুমি থাকবে৷ আমাদের ক্লাবের ফাংশানে গান গাইবে—তার জন্যে কিছু টাকাও পাবে—৷’
আমার কথা শেষ হতে না হতেই মোহন মোড়া থেকে ছিটকে এসে আমার পায়ের কাছে বসে পড়ল৷ ওর দেশোয়ালি ভাষায় কীসব বলতে লাগল৷
আমি হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠেই ‘কী করছ! কী করছ!’ বলে ওকে ধরে তুললামঃ ‘শোনো, মোহন৷ তোমার সঙ্গে আরও জরুরি কথা আছে…৷’
মোহন কৃতজ্ঞতায় বিহ্বল ভাবটা সামলে নিয়ে আবার মোড়ায় গিয়ে বসল৷ উৎসুকভাবে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে৷
‘…আর পাঁচ-ছ’দিনের মধ্যেই আমরা ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ গিয়ে ঢুকছি৷ আমি, মহাবীর যাদবজী, ভোলেনাথের মন্দিরের পুরোহিত রামপ্রসাদ তেওয়ারিজী—আর তুমি৷’
‘আমি!’
‘হ্যাঁ—তুমি৷ ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর ভূতিয়াঘর বদনাম খতম করতে হবে৷ তারপর ওই জমিতে কারখানা হবে৷ সেখানে তোমার এই গাঁয়ের ছেলেছোকরারা নোকরি পাবে—তুমিও পাবে৷’
মোহন আমাকে এ নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল৷ আমিও খোলাখুলি ওর সঙ্গে কথা বললাম৷
শেষে বললাম, ‘দ্যাখো, তোমার ওই ভূতুড়ে বাড়িতে ঢোকার এক্সপিরিয়েন্স আছে—তাই তোমাকে আমরা সঙ্গে চাইছি৷ তা ছাড়া তোমাকে কিছু টাকাও দেওয়া হবে৷’