ইনভেস্টিগেশানে আরও অনেক কিছু জানা গিয়েছিল৷
প্রথমবার বাজ পড়তেই হসপিটালে আগুন ধরে গিয়েছিল৷ পাঁচতলা থেকে চারতলায় নামার সিঁড়ির অংশ বড়-বড় ফাটল ধরে ধসে পড়েছিল৷ বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে ছুটোছুটি করে লিফটে উঠতে যায়৷
হসপিটালে একটা প্রকাণ্ড মাপের লিফট ছিল৷ সেটা একইসঙ্গে ছিল পেশেন্ট পার্টি ওঠা-নামার লিফট আর মালপত্র, যন্ত্রপাতি, পেশেন্টসমেত স্ট্রেচার ইত্যাদি ওঠা-নামা করানোর সার্ভিস লিফট৷
লিফটটা ছিল বলতে গেলে জোব চার্নকের আমলের, ওঠা-নামা করার সময় প্রবল শব্দ হত, আর আরোহীরা নিজেরাই হাতল ঘুরিয়ে ওটাকে চালাত—কোনও লিফটম্যান ছিল না৷
তো ওই সাতাশটা ছেলেমেয়ে প্রাণের ভয়ে হুড়োহুড়ি করে সেই লিফটটায় উঠে পড়েছিল৷ হাতল ধরে এলোমেলো টানাটানি করে ওটাকে চালু করে দিয়েছিল৷ তারপর…৷
তারপর লিফট যখন সবে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে তখন দ্বিতীয় বাজটা পড়ে৷ তাতে নিশ্চয়ই লিফটে আগুন ধরে গিয়েছিল, কারণ ওই বন্ধ লিফটের ভেতরেই সাতাশটা ছেলেমেয়ের বডি পাওয়া গিয়েছিল৷
কী বীভৎস ব্যাপার! অথচ কারও কিছু করার ছিল না৷
ওইসব পোড়া বডিগুলোর মধ্যে একটা ছিল লছমির৷
লছমির কানে রুপোর মাকড়ি ছিল৷ ফোরেনসিক টিম জানিয়েছিল, ওই মাকড়িগুলো নাকি ট্রেস করা গিয়েছিল৷ রুপোর মেল্টিং পয়েন্ট ৯৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ তাই ওগুলো বেঁকেচুরে গেলেও গলে যায়নি৷
ব্যস, এই ঘটনার পর থেকে জনতা সেবাকেন্দ্র শেষ হয়ে গেল৷ ভূতিয়াঘর বলে দাগিও হয়ে গেল৷
তারপর থেকে বাড়িটাকে নিয়ে নানান জনে নানান কথা বলে৷
কেউ বলে, মাঝে-মাঝে নাকি বাড়িটায় আলো জ্বলতে দেখা যায়৷ আবার কেউ-কেউ ও-বাড়ি থেকে ছোট-ছোট ছেলেমেয়ের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনেছে বলে দাবি করেছে৷
রাখিতপুর এমনই একটা পিছিয়ে থাকা জায়গা যে, এখানে কোনও কিছুর গায়ে একবার দাগ লেগে গেলে সে-দাগ তোলা মুশকিল৷
‘…ওই বেঁকেচুরে যাওয়া মাকড়ি দুটো আমার কাছে এখনও আছে৷ ছোটবেলা থেকে দেখেছি, ওই মাকড়িগুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে আমার মা কী কান্নাটাই না কাঁদত৷ সেই কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেলতাম৷ সবই ভগবানের মরজি…৷’
লছমির মর্মান্তিক পরিণতির কথা বলতে-বলতে মহাবীর যাদব বারবার চোখ মুছছিলেন, নাক টানছিলেন৷ তারপর একসময় নিজেকে সামলে নিতে পারলেন৷ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন৷
কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, ‘‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর গায়ের দাগ তো তুলতে হবে৷ তার কিছু ব্যবস্থা করলেন?’
মহাবীরজী মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি একজন অচেনা মানুষ৷ লছমির কথা বলতে-বলতে তিনি কোথায় যেন ভেসে চলে গেছেন৷
অন্তত দশ সেকেন্ড পর আমার কথার খেই ধরতে পারলেন৷ তখন থেমে-থেমে নীচু গলায় বললেন, ‘আপনি তো জানেন, এ-গাঁয়ের উত্তরদিকে একটা ছোটামোটা শিবমন্দির আছে৷ ও-মন্দিরের পূজারি আছেন রামপরসাদ তিওয়ারি৷ তিওয়ারিজীকে আমি ব্যাপারটা খুলে বলেছি৷ বলেছি ওই দাগি অস্পাতালে ক্রিয়াকরম করে ওটার দাগ মেটাতে হবে৷ তার জন্য আমি পূজারিজীকে পানসো রুপেয়া দকশিনা দেব৷ আর মন্দিরে ডোনেসান দেব পানসো রুপেয়া৷
‘আমার কথায় তিওয়ারিজী রাজি হয়ে গেছেন৷ উনি দিন আর লগন বলে দেবেন—তো সেইদিন ঠিক টাইমে গিয়ে আমরা ও-বিল্ডিংটায় সব রুমে ঠাকুরমশাইকে দিয়ে পুজোপাঠ করিয়ে নেব৷ তখন লছমির আতমা শান্তি পাবে, মুক্তি পাবে৷ শুধু লছমি কেন, ওই বিল্ডিং-এর সব আতমাই মুক্তি পেয়ে যাবে৷ তখন ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর শাপ মুছে যাবে৷ আমার মনও শান্তি পাবে৷’
যে-শিবমন্দিরের কথা মহাবীর যাদব বলছেন, সেই শিবমন্দিরে আমি একবার পুজো দিতে গিয়েছিলাম৷ সেখানে হর-পার্বতীর মূর্তি রয়েছে৷ মন্দিরের পুরোহিত রামপ্রসাদ তিওয়ারিকে আমি দেখেছি৷ বয়েস বেশি নয়—বড়জোর চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে৷ ছিপছিপে লম্বা চেহারা৷ মাথায় কদমছাঁট চুল৷ পেছনদিকে জুতসই টিকি৷ পুজো করার সময় লক্ষ করেছি, রামপ্রসাদজী টিকিতে ফুল বেঁধে রাখেন৷ আর সবসময় ওঁর কপালে আঁকা থাকে চন্দনের আঁচড়৷
মহাবীরজী ‘ছোটামোটা’ বললেও মন্দিরটা দেখতে বেশ সুন্দর৷ মন্দিরের মাথায় লাল রঙের ত্রিশূল৷ ছোট্ট দরজার মুখে ওপর থেকে ঝোলানো পেতলের ঘণ্টা৷ মন্দিরের সামনে শান বাঁধানো চত্বর৷ পুজোর সময় ভক্তরা সেখানে বসে পুজো দ্যাখে, অন্যসময় নাম-গান শোনে৷
মন্দিরের দরজা থেকে হাতচারেক দূরে শানপাথরের ওপরে বসানো রয়েছে একটা ষাঁড়ের মূর্তি৷ মূর্তিটা মাপে ছোট, কালো পাথরের তৈরি—মন্দিরের মূর্তির দিকে চেয়ে ষাঁড়টা অলসভাবে বসে আছে৷
আমি মহাবীরজীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম৷ তা হলে ‘দাওয়াই টাউন’-এর বদনাম ঘোচাতে এগিয়ে যাব আমরা তিনজন—আমি, মহাবীর যাদব আর রামপ্রসাদ তিওয়ারি?
আমার মনটা একটু খচখচ করতে লাগল৷ আমাদের সঙ্গে মোহন যাদবকে নিলে হত না? ওর ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভেতরে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা আছে—সে চুরি করতে গিয়েই হোক, বা অন্য কোনও কু-কাজ করতে গিয়েই হোক৷ আমার মন বলছিল, মোহন আমাদের সঙ্গে গেলে ভালোই হবে৷ কিন্তু মোহন আমার সঙ্গে আর দেখা করতে আসেনি৷ মহল্লায় শুনলাম, ও ওর বাবাকে নিয়ে ধানবাদের কোন হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট করাতে গেছে৷ তা ছাড়া ওকে দেখে যেটুকু বুঝেছি, ও আমাকে এড়িয়ে চলার মতন ছেলে নয়৷