সময়টা ফাল্গুন মাস হলেও বেশ কয়েকদিন ধরে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি! তাতেই হয়তো কোন এক ফাঁকে ঠান্ডা থাবা বসিয়ে দিয়েছে৷
এক দুপুরে চাদর মুড়ি দিয়ে খাটিয়ায় শুয়ে আছি, এমন সময় মহাবীরজী আমার আস্তানায় এলেন৷ বাইরে তখন ঘ্যানঘেনে বৃষ্টি চলছে৷
ওঁকে দেখে আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম৷ ঘরের একমাত্র মোড়াটা কাছেই ছিল৷ মহাবীরজীকে সেখানে বসতে বললাম৷
উনি সে-কথা না শুনে তক্তপোশে আমার পাশটিতে বসলেন৷ বললেন, ‘আজ কেমন আছেন?’
আমি অল্প হেসে বললাম, ‘কালকের চেয়ে বেটার…৷’
মহাবীরজী আমার গায়ে হাত দিয়ে জ্বর পরখ করলেন৷ বললেন, ‘এরকম বে-টাইমের বারিশ—মহল্লাতে অনেকেরই বোখার-উখার হচ্ছে৷ তা আপনি দাওয়াই নিচ্ছেন তো?’
ওঁকে জানালাম যে, আমার সঙ্গে সবসময় হোমিওপ্যাথিক ওষুধ থাকে—সেটাই রেগুলার চার্জ করছি…৷
মহাবীর যাদব খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিলেন৷ ওঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, উনি দূরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন৷
হঠাৎই আমার দিকে ফিরে তাকালেন মহাবীর৷ ওঁর চোখের দৃষ্টিটা কেমন অদ্ভুত লাগল৷ মনে হল, উনি আমাকে কিছু বলতে চান৷
কয়েক সেকেন্ড ওইরকমভাবে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, ‘পমেশজী, আজ লছমির জনমদিন৷ লছমি কেমন করে মারা গেল সেই কাহানিটা আজ আপনাকে বলব…৷’
আমি চুপ করে রইলাম৷ এরকম একটা মুহূর্তে কথা বলতে নেই৷ কথা বললে ওঁর ভাবনার সাবলীল স্রোত এলোমেলো হয়ে যাবে৷
‘লছমি আমার পেয়ারি বহেনা ছিল৷ সুন্দর, ফুটফুটে—যেন একটা কথা-বলা পুতুল…৷’
ঘটনাটা বহুকাল আগের৷ মহাবীর যাদবের বয়েস তখন ছিল তেরো কি চোদ্দো বছর৷ আর লছমির বয়েস? এগারো কি বারো৷ সময়টা ছিল বর্ষাকাল৷ ক’দিন ছাড়া-ছাড়াই ঘোর বৃষ্টি৷ আর মেঘ? মেঘের দল তখন টুয়েন্টি ফোর সেভেন আকাশের দখল নিয়ে নিয়েছে৷ সবসময়েই গুড়গুড় গুড়ুম-গুড়ুম চলছে৷ আর বিজলির তলোয়ার রাত নেই দিন নেই আকাশকে ফালা-ফালা করে চলেছে৷
এরকম একটা দুর্যোগের সময়ে আর-একটা দুর্যোগ নেমে এসেছিল রাখিতপুরে৷
মহাবীরজীদের মহল্লা থেকে কিলোমিটারটাক দূরে একটা প্রাইমারি স্কুল ছিল৷ সেই স্কুলে ক্লাস ফোর-এ পড়ত লছমি৷ স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়েছে বলে স্কুলের প্রেসিডেন্ট ভোজের আয়োজন করেছিলেন৷ সেই ভোজ খেয়ে স্কুলের অনেক ছেলেমেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল৷ পেট ব্যথা, গা গুলোনো, তার সঙ্গে পেটখারাপের সমস্যা৷ তো সাতাশজন ছেলেমেয়েকে ওই জনতা সেবাকেন্দ্রে ভরতি করা হয়েছিল৷ ওদের সবাইকে রাখা হয়েছিল পাঁচতলার চিলড্রেন্স ওয়ার্ডে৷
দু-দিন কাটতে না কাটতেই একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেল৷ এমন ঘটনা যার ওপরে কারও হাত ছিল না৷ সবটাই ওপরওয়ালার বিধান৷
সময়টা ছিল সন্ধেবেলা৷ তখন বোধহয় সাড়ে ছ’টা কি সাতটা হবে৷ আকাশে মেঘ-বৃষ্টি আর বজ্র-বিদ্যুতের রাজ যেমন চলছিল সেটা সেদিন বিকেলের পর যেন চার-পাঁচগুণ বেড়ে গিয়েছিল৷ মহল্লার সবাই আলোচনা করছিল যে, এরকম দুর্যোগের ঘনঘটা তারা বহু বছরের মধ্যে দেখেনি৷
ওই সাড়ে ছ’টা-সাতটার সময় একটা বাজ পড়ল৷ বাজ তো নয়, যেন অ্যাটম বোমা! আর তার আলো এমন ছিল যেন এক লক্ষ ওয়াটের ফ্ল্যাশগান ব্যবহার করে কেউ আকাশ থেকে আমাদের গাঁয়ের ফটো তুলল৷ সেই তীব্র আলোর টুকরো জানলা-দরজার ফাঁকফোকর আর ফাটল দিয়ে গাঁয়ের সবার ঘরের দেওয়ালে ঝলসে উঠল৷
বাজ পড়ার পরই অনেক মানুষ কৌতূহলে উঁকিঝুঁকি মারল বাইরে৷ তখনই দেখা গেল, জনতা সেবাকেন্দ্রের বিল্ডিংটা দাউদাউ করে জ্বলছে৷ মহাবাজ ভীষণ আক্রোশে ছোবল মেরেছে তার মাথায়৷
দুসরা গাঁয়ে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল৷ নিজেদের আত্মীয়স্বজন আর ছেলেমেয়ের চিন্তায় সবাই পাগলের মতো হয়ে গেল৷ বৃষ্টিতে ভিজেই সব ছুটল ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে৷ মুখে বুকফাটা আর্তনাদ৷
সেসময়ে আবার একটা মহাবাজ পড়ল৷ ওই জনতা সেবাকেন্দ্রের বিল্ডিং-এই৷ আগুন আরও তেজিয়ান হয়ে উঠল৷ ছুটন্ত মানুষগুলো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ওরা আগুনের শিখা দেখতে পাচ্ছিল৷ বৃষ্টি সেই আগুনকে একফোঁটাও বাগে আনতে পারছিল না৷
অন্ধকারের মধ্যেই মানুষের দল আবার ছুটতে শুরু করল৷ ওদের চোখের জল বৃষ্টির জলে মিশে যাচ্ছিল৷ গায়ের জামাকাপড় ভিজে সপসপে৷ ছুটতে খুবই অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু তাও ওরা মরিয়া হয়ে ছুটছিল৷ তার সঙ্গে ছুটছিল ওদের কান্নাকাটি আর শোরগোল৷
ওরা যখন দলে-দলে ‘দাওয়াই টাউন’-এর কাছে এসে জায়গাটাকে ঘিরে দাঁড়াল, তখনই কোন এক ম্যাজিকে বৃষ্টিটা কমে গেল হঠাৎ৷ দাউদাউ আগুন আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল৷ ‘দাওয়াই টাউন’-কে ঘিরে কান্না আর হইচইয়ের রোল উঠল৷ দু-দশজন সাহসী লোক ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল বিল্ডিং-এর ভেতরে৷ কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত কোনও লাভ হয়নি৷
অ্যাক্সিডেন্টের পরে পুলিশ এসেছিল, দমকলের লোক এসেছিল, সরকারি দপ্তরের লোকজনও এসেছিল৷ প্রায় সাতদিন ধরে ওরা ছানবিন করেছিল৷ অনেক উন্ডেড মানুষকে ওরা চিকিৎসার জন্যে গোবিন্দপুর আর ধানবাদের দুটো হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল৷ তা ছাড়া অনেক লাশও উদ্ধার করেছিল৷
তার মধ্যে ছোটমাপের সাতাশটা লাশ ছিল৷ সরাসরি সবাইকে শনাক্ত করা না গেলেও লোকজনকে জিগ্যেস করে, নানান রেকর্ড ঘেঁটে ওই সাতাশ জনের পরিচয় মোটামুটিভাবে জানা গিয়েছিল৷ কিন্তু তাতে আর লাভ হল কী!