সাদা হাফ শার্ট কালো প্যান্টের ভেতরে গুঁজে পরেছেন৷ কোমরে বেল্ট বেঁধে নেয়াপাতি ভুঁড়িটিকে সামলে-সুমলে রেখেছেন৷
মিস্টার মিশ্রকে দেখে মোটেই কোনও হাই-ফাই কোম্পানির চেয়ারম্যান অথবা ম্যানেজিং ডিরেক্টর—কোনওটাই মনে হয় না৷ বরং ওঁর চেহারা আর চোখ-মুখ দেখে ফিল্মের কমেডিয়ান বলে মনে হয়৷
মিশ্রজী পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে বসালেন৷ আমাকে আর মহাবীরজীকে অফার করলেন৷
আমি হেসে জানালাম যে, ট্রেনের ধোঁয়াতেই আমি বুঁদ হয়ে আছি, অন্য কোনও ধোঁয়াতে তেমন মজা পাই না৷
মহাবীর যাদব সিগারেটের অফার অ্যাকসেপ্ট করলেন৷ মিশ্রসাহেব পকেট থেকে সোনালি লাইটার বের করে মহাবীরজীর সিগারেট ধরিয়ে দিলেন, তারপর নিজেরটা ধরালেন৷
বেশ মওজ করে ধোঁয়া ছাড়লেন দুজনে৷ সেই ধোঁয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বদ্রীনাথ মিশ্র৷ তারপর মহাবীরজীর দিকে নজর নিয়ে এসে ভুরু উঁচিয়ে হাত নেড়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা হবে?’
আমি বললাম, ‘স্টেশানে আমার ঘরটায় গিয়ে আমরা বসতে পারি—৷’
মহাবীর মিশ্রসাহেবকে অনুরোধ করলেন, ‘চলিয়ে না, স্যার…৷’
কিন্তু মিশ্রসাহেব কী ভেবে হাত নেড়ে বললেন, ‘নহি—হামে জরা জলদি ভি হ্যায়৷ ছোটাসা ডিসকাশন—এহিপে ডিসকাস কর লেতে হ্যায়…৷’
তো ওই জিপের পাশে দাঁড়িয়েই আমাদের কথাবার্তা হল৷ মিশ্রসাহেব আর মহাবীরজী একটু নীচু গলায় কথা বলছিলেন৷ ওঁদের ঢঙের ছোঁয়ায় আমারও গলার পরদা কখন যেন নেমে গেল৷
সত্যি-সত্যিই ছোট ডিসকাশন৷
মিশ্রসাহেবের সোজাসুজি বক্তব্য, ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভূতুড়ে বদনাম না হঠালে তিনি ওটা কিনতে পারবেন না আর ফ্যাক্টরি তৈরির জন্যে টাকাপয়সাও ইনভেস্ট করতে পারবেন না৷ কারণ, ফ্যাক্টরিতে লোকজন স্টাফ সব লাগালে তারা হয়তো ভূত-পিরেতের ভয়ে পালিয়েই যাবে৷ তখন মিশ্রজীর ইনভেস্ট করা কোটি-কোটি টাকার সত্যনাশ হবে৷ সুতরাং, আগে জায়গাটাকে শোধন করতে হবে৷ মহাবীরজী দায়িত্ব নিয়ে যদি সে-কাজ করে দিতে পারেন তাহলে ‘দাওয়াই টাউন’ কেনার ব্যাপারে মিশ্রসাহেব শান্তিতে এগোতে পারেন৷ জায়গাটাতে পুজো-পাঠ আর শোধনের কাজের জন্য যা খরচাখরচ হবে তার জন্যে মিশ্রজী এখনই পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজি আছেন৷
কথা বলতে-বলতে বদ্রীনাথ মিশ্র পকেট থেকে একশো টাকার নোটের গোছা বের করে ফেলেছেন এবং গুনতে শুরু করেছেন৷
আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে মহাবীর যাদবের দিকে তাকালাম৷ দেখলাম, ওঁর সরল চোখে লোভের চকচকে ছায়া৷
আমার মনে হচ্ছিল, এ-ব্যাপারটার মধ্যে না ঢুকলেই ভালো হত৷ কিন্তু এখন তো ফেরার পথ নেই!
বদ্রীনাথজীর হাত থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার সময় মহাবীর যাদব যা বললেন তাতে আমার ফেরার পথ আরও বন্ধ হয়ে গেল৷
‘আপনি চিন্তা করবেন না, মিসরাজী৷ মাস্টারজী আমার সঙ্গে আছেন৷ ওনার মতো পড়ালিখা আদমি সঙ্গে থাকলে আমি অনেক ভরোসা পাই৷ আমাদের মহল্লায় সবাই মাস্টারজীকে বহত রিসপেক্ট করে…৷’
বদ্রীনাথ মিশ্র আমার দিকে একবার দেখলেন৷ বোধহয় আঁচ করতে চাইলেন, ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভূতিয়াঘর বদনাম ঘোচানোর কাজে আমি পজিটিভ রোল প্লে করতে পারব কি না৷
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, মহাবীর যাদবকে দেখে যতটা সহজ-সরল মনে হয় আসলে হয়তো ততটা নন৷ আরও মনে হল, মিশ্রসাহেব যদি ওই বিশাল জমিটা কিনে নেন, তাহলে মিডলম্যান হিসেবে মহাবীর যাদবেরও দশ-বিশ হাজার টাকা ইনকাম হয়ে যাবে৷
মহল্লার লোকজন যাতে ঝামেলা না করে সেইজন্যেই কি সবাই ‘রিসপেক্ট’ করে এমন একজনকে সঙ্গে চাইছেন মহাবীর?
আমার মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করতে লাগল৷ না, জমির দালালির টাকায় আমার কোনও আকর্ষণ নেই৷ তবে ওই ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভূত তাড়ানোর ব্যাপারে আমার যথেষ্ট আকর্ষণ এবং আগ্রহ আছে৷
কথাবার্তা শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ হাসিমুখে জিপে ওঠার সময় বদ্রীনাথজী মহাবীর যাদবের ডানহাতটা ধরে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘ওই জমিন যদি কিনে নিতে পারি তো আপনাকে একেবারে খুশ করে দিব৷ আপ বেফিকর রহিয়ে, মহাবীরজী—৷’
জিপ স্টার্ট দিল৷ ধুলো উড়িয়ে বদ্রীনাথ মিশ্র চলে গেলেন৷
মহাবীর যাদব মনের আনন্দ যেন আর চেপে রাখতে পারছিলেন না৷ আমার হাত ধরে আবেগমাখা গলায় বললেন, ‘আপনি সাথে থাকলে আমি অনেক জোর পাব, পমেশজী৷ জনতা সেবাকেন্দ্রের ওই ভূতিয়াঘর বদনাম—উও বদনাম য্যায়সে ভি হো মিটানা হি পড়েগা, কিঁউ?’
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘অবশ্যই—৷’
মহাবীর যাদব খুশি হলেও কেন জানি না, আমি খুব একটা খুশি হতে পারছিলাম না৷ ওই হাসপাতালটার ভেতরের নানান অজানা ভয় আমার বুকের ভেতরে আঁচড় কাটছিল৷ হিংস্র বাঘের নখের আঁচড়৷
‘দাওয়াই টাউন’-এর বদনাম ঘোচানোর ব্যাপারে মহাবীর যাদবের আগ্রহের একটা বড় কারণ হয়তো ওঁর বোন লছমি, কিন্তু তার পাশাপাশি লক্ষ্মীলাভের আগ্রহটাও বোধহয় বড় কম নয়৷ গতকাল হাবভাব আর কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি বদ্রিনাথ মিশ্র যথেষ্ট বড়লোক এবং ‘দাওয়াই টাউন’-এর জায়গাটাতে উনি সিরিয়াসলি একটা ফ্যাক্টরি খুলতে চান৷
কিন্তু আমি যে জড়িয়ে পড়লাম সেটার কী করি!
ব্যাপারটা নিয়ে এ-কথা সে-কথা ভেবে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিলাম৷ তারপর হঠাৎ করেই ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বরে পড়লাম৷