আমি বললাম, ‘সেই ভালো৷ তবে আজ নয়—কাল৷ তুমি কাল সন্ধেবেলা সাড়ে ছ’টা কি সাতটায় আমার ঘরে এসো৷ এসব নিয়ে কাউকে কিছু এখন বোলো না—৷’
মোহন অনেকখানি ঘাড় কাত করল৷ বলল, ‘না, কাউকে কুছু বলব না…৷’
কাল ওকে আসতে বললাম, কারণ, রোববার সন্ধেটা আমি নিজের পছন্দের বইপত্র নিয়ে পড়াশোনার মধ্যে থাকি৷
এমন সময় দূরে দেখা গেল ট্রেন আসছে৷ তার হুইসলের শব্দ বাতাসে কেঁপে-কেঁপে কাছে এগিয়ে আসছে৷ ছোটবেলা থেকে এই শব্দটা আমার দারুণ প্রিয়৷ শুধু এই শব্দটা শোনার জন্যেই আমি বাড়ির কাছাকাছি রেল-স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম৷ মনে হত, এই মায়াবী শব্দটার পিঠে চড়ে আমি বহুদূর চলে যেতে পারি৷
বড় হয়ে ওঠার পরেও এই অলৌকিক টানটা এতটুকুও বদলায়নি৷ সেইজন্যেই রাখিতপুরের একঘেয়ে জীবনেও আমার হাঁপ ধরেনি৷
মোহন যাদব ট্রেনে উঠে চলে গেল৷ ওর এক সঙ্গী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে খইনি চাপড়াতে লাগল৷
ট্রেনটা ধীরে-ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছিল৷ তার কালো ধোঁয়া ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে৷
আমি আনমনা হয়ে সেসব দেখছিলাম৷ হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলঃ ‘পমেশজী…৷’
আমি চমকে ঘুরে তাকালাম৷
মহাবীর যাদব৷
আজ ওঁর মুখে সেই বিষণ্ণ ভাব নেই৷ বরং মানুষটাকে অল্পবিস্তর খুশি-খুশি বলেই মনে হল৷
‘মোহনের সঙ্গে বাতচিত করছিলেন? গাল-গলার ওই জখমি দাগ নিয়ে?’
আমি হেসে বললাম যে, ওই কাটা দাগ নিয়ে আমার যথেষ্ট কৌতূহল থাকলেও ওকে সে নিয়ে কিছু জিগ্যেস করিনি৷ বরং কলকাতায় আমাদের ক্লাবের ফাংশানে ও গান গাইতে রাজি আছে কি না সে-কথাই জানতে চাইছিলাম৷ ও রাজি আছে৷ আমি সামনের মাসে কলকাতায় যাব—তখন কথাবার্তা বলে সব ফাইনাল করে আসব৷ তা উনি অসময়ে স্টেশনে এসেছেন কেন?
মহাবীর যাদব বললেন, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল, মাস্টারজী৷’
‘চলুন—আমার ঘরে চলুন—৷’
‘আমার ঘর’ বলতে পাকা দেওয়াল, টিনের ছাউনি, একটা টেবিল, দুটো চেয়ার আর একটা লম্বা বেঞ্চি৷ রাখিতপুর টাইপের স্টেশনে স্টেশন মাস্টারের যেরকম টাইপের ঘর হওয়া স্বাভাবিক সেইরকম৷
মহাবীর বললেন, ‘না, না, তার দরকার নেই৷ একজনের সঙ্গে আপনার কথা করাব৷ ওই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর ব্যাপারে৷ ভদ্রলোক খুব রইস আদমি৷ মিস্টার মিসরা৷ কুমারডুবিতে ওনাদের মেডিসিন ফ্যাক্টরি আছে৷ তো মিসরাসাহেব ওই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ কিছু একটা করতে চান৷ লেকিন…৷’
‘লেকিন কী?’
‘মাস্টারজী, মিসরাসাহেব স্টেশনের বাইরে গাড়িতে আছেন৷ আপনি যদি বাইরে এসে ওনার সঙ্গে একটু বাতচিত করেন তো ভালো হয়৷ এখন তো আর টিরেন-উরেন কিছু নেই….৷’
আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ এর মধ্যে আবার আমি কেন!
সে-কথাই মহাবীরকে বললাম৷
‘দেখুন, আমি এখানে নতুন লোক৷ আগে-পিছে কিছুই জানি না৷ আপনারা লোকাল লোক—কথাবার্তা যা বলার আপনারাই বলুন৷ আমাকে আর এর মধ্যে জড়াবেন না…৷’
‘জড়াতাম না, পমেশজী৷ কিন্তু আমরা অনপঢ় গাঁওয়ার, আর আপনি লিখাপড়া জানা কোয়ালিফাই আদমি৷ তাই আমি চাই মিসরাজীর সঙ্গে কথা করার সময় আপনি থাকবেন৷ চিন্তা করবেন না—আমি আমাদের মুখিয়ার সঙ্গে কথা করে এ ব্যাপারে পারমিসশান নিয়ে নিয়েছি৷ এবার তো চলুন! মিসরাসাহেব অনেকক্ষণ ওয়েট করছেন…৷’
এরপর আর ওজর-আপত্তি চলে না৷ অগত্যা মহাবীরজীর সঙ্গে হাঁটা দিলাম স্টেশনের বাইরে৷
স্টেশনের বাইরেটা সাধারণত যেমন জমজমাট হয় এখানে ততটা নয়৷ তবে বেশ কয়েকটা খাবারের দোকান আর চায়ের স্টল আছে৷ এছাড়া ট্রেনের সময় ধরে দু-একটা ভ্যান-রিকশাও পাওয়া যায়৷
মহাবীরজীর সঙ্গে স্টেশনের বাইরে এলাম৷ আসার পথে তিনি বললেন, ‘মোহনের থেকে আপনিই কথা বের করতে পারবেন৷ আপনাকে ও বহত রিসপেক্ট করে…৷’
আমি অবাক হয়ে মহাবীরজীর মুখের দিকে তাকালাম: ‘কী কথা?’
‘ওই কাটা দাগের ব্যাপারটা…৷’
‘ও—৷’ বলে আমি চুপ করে গেলাম৷
স্টেশনের বাইরে অনেক ফাঁকা জায়গা৷ তার বেশিরভাগ ঘাসে ছাওয়া—বাকি জায়গায় দুটো ছোট-ছোট পুকুর৷ তা ছাড়া এদিকে-ওদিকে অনেক বড়-বড় গাছ৷ তাদের সবুজ পাতা বাতাসে দুলছে৷ আর সেইসব পাতার আড়াল থেকে ঘুঘু আর বসন্তবৌরি ডাকছে৷ কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ‘দাওয়াই টাউন’-এর কথা ভুলে গেলাম৷
স্টেশন এলাকা ছেড়ে বেরোতেই ঢালু কাঁচা পথ৷ সেই পথ ধরে নেমে আট-দশ পা গেলে সারি বেঁধে কয়েকটা দোকান৷ দোকানগুলো ছাড়িয়ে একটা টিউবওয়েল৷ সেখানে লোকজন বালতি আর কলসি নিয়ে জল ভরছে৷
টিউবওয়েলের পরে রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল৷ তার সামনের কাচে কোম্পানির নাম লেখা একটা নীল রঙের স্টিকার লাগানো৷
মহাবীরজী বললেন, ‘ওই যে, মিসরাসাহেবের জিপ৷ উনি জিপের ভেতরে বসে আছেন৷’
আমরা পায়ে-পায়ে টিউবওয়েলের কাছে যেতেই একজন বেঁটেখাটো লোক জিপের প্যাসেঞ্জার সিট থেকে রাস্তায় নেমে দাঁড়াল৷ ইনিই বোধহয় মিস্টার মিশ্র৷
কাছে যেতেই মহাবীর যাদব পরিচয় করিয়ে দিলেন৷
‘মিশ্র ল্যাবরেটরিজ প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের বিখ্যাত মেডিসিন কোম্পানির চেয়ারম্যান অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার বদ্রীনাথ মিশ্র৷
বদ্রীনাথজীর চোখে কালো ফ্রেমের চশমা৷ চেহারা বেশ মোটাসোটা৷ গাল দুটো ডুমো-ডুমো৷ ঠোঁটের ওপরে কাঁচাপাকা গোঁফ৷ মাথার চুল যথেষ্ট পরিমাণে তেল-টেল মেখে পেতে আঁচড়ানো৷ দু-চোখে মজাদার মেজাজের ছোঁওয়া৷