ফিরে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই মহাবীর যাদবের মুখোমুখি হয়ে গেলাম৷ উনি কখন যে গাছের গুঁড়ি ছেড়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাইনি৷
মহাবীরজী আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন৷ বোধহয় আমার মনের ভেতরটা পড়ে নিতে চাইছিলেন৷
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘হঠাৎ করে হসপিটালটা ভূতিয়াঘর হয়ে গেল কেমন করে? সেই কাহানিটা তো বললেন না?’
মহাবীরজী ঠোঁটে হাসলেন—মেঘলা আকাশের মতন হাসি৷ ভিজে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ৷ তারপর ছাতার ডগাটা মাটিতে ঠুকলেন কয়েকবার৷ বোঝাই যাচ্ছিল, তিনি কিছু একটা ভাবছেন৷ হয়তো ভাবছেন, হসপিটালটার ভূতিয়াঘর হয়ে ওঠার কাহিনি আমাকে বলবেন কি বলবেন না৷
আকাশের মেঘ কখন যেন আরও ঘন হয়েছে৷ হসপিটালের মাথায় এখন শ্যামলা রঙের ছাতা৷ মেঘের গলাখাঁকারি শোনা গেল৷ কয়েকটা পাখি ডেকে উঠল কোথাও৷
‘বলব—সবই বলব৷’ মহাবীর যাদব আবেগমাখা চোখে তাকালেন আমার দিকেঃ ‘আর আমি না বললেও ভি আপনি জানতে পারবেন৷ মহল্লার কেউ না কেউ তো আপনাকে বলবে! তবে এখন—এই অস্পাতালের সামনে দাঁড়িয়ে সেই কাহানি বলতে ভালো লাগছে না৷ পরে বলব৷ এখন শুধু এটুকু শুনে রাখুন, ওই হাসপাতালে একটা হাদসা হয়েছিল, আমাদের গাঁয়ের প্রাইমারি ইস্কুলের সাতাশটা বাচ্চা-বাচ্চা ছেলে-মেয়ে মারা গিয়েছিল৷’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মহাবীরজী৷ হাসপাতালটার দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ ওঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল৷ আমি ওঁর বিষণ্ণ মুখের দিকে চেয়ে রইলাম৷
অনেকক্ষণ পর মানুষটা মুখ খুললেন, ‘পমেশজী, ওই সাতাশটা বাচ্চার মধ্যে আমার বহেন লছমিও ছিল৷ সেইজন্যেই আমি ভূতিয়াঘরের ভূত-পিরেতকে খতম করে এই টাউনের বদনাম হঠাতে চাই৷ সেটাই হবে আমার ছোটি বহেনকে ছিনিয়ে নেওয়ার বদলা৷ তাই আমি চাই এই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ কোনও ফ্যাক্টরি-উক্টরি হোক…৷’
আমি চুপ করে মানুষটাকে দেখতে লাগলাম৷ কল্পনায় দেখতে পেলাম, একটা বাচ্চা মেয়ে, টাউনের মাঠে ছুটোছুটি করে খেলছে৷ তার গায়ে স্কুলের ইউনিফর্ম৷ মাথার পিছনে একজোড়া ছোট্ট বিনুনি৷ তার ডগায় লাল ফিতের ফুল৷
লছমির ঠিক কী হয়েছিল এই হসপিটালে?
মহাবীরজী আমাকে বললেন, ‘চলুন, মাস্টারজী—ওয়াপস চলতে হ্যায়৷ এখুনি বারিশ এসে যেতে পারে…৷’
আর কোনও কথা না বলে আমরা ফেরার পথ ধরলাম৷
কয়েক পা এগোতে না এগোতেই আমাদের ছাতা খুলতে হল৷
এর দিন চার-পাঁচ পরেই মোহন যাদবের সঙ্গে আমার বেশ আলাপ হয়ে গেল৷ দিনটা ছিল শুক্রবার৷ বেলা এগারোটা হলেও আকাশ মেঘলা থাকায় সময়টা ভোরবেলা বলে মনে হচ্ছিল৷
আমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ মেঘলা আলো গায়ে এসে পড়ছিল৷ বেলা বাড়লেও আলো তেমন বাড়েনি৷ চারপাশে কেমন একটা মিঠে ব্যাপার ছড়িয়ে আছে৷
এই স্টেশনে একটাই প্ল্যাটফর্ম—তাও আবার কাঁচা, ইটের লাইনিং দিয়ে বাঁধানো৷ প্ল্যাটফর্মে বেশ কয়েকটা বড়-বড় গাছ৷ তাদের ছায়ার দৌলতে প্ল্যাটফর্মের মানুষজন একটু ছায়া-টায়া পায়৷
স্টেশনের গা ঘেঁষে একটা সরু খাল৷ তার দু’পাশে সবুজ গাছপালা৷ সেখানে সবসময়েই এ-পাখি সে-পাখি ওড়ে৷ আমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সবুজ আর পাখি দেখছিলাম৷ তখনই মোহনকে নজরে পড়ল৷
কেঁচোর মতো নেতানো স্পিডের একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন সোম-বুধ-শুক্র আমার স্টেশন হয়ে ধানবাদের দিকে যায়৷ বোধহয় সেই ট্রেনটা ধরার জন্যেই মোহন যাদব একটা ময়লা থলে হাতে ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে৷
আমিই এগিয়ে গিয়ে গায়ে পড়ে ওর সঙ্গে আলাপ জমালাম৷
মোহন দু-চারজন ছেলের সঙ্গে গল্প করছিল৷ গায়ে নীল আর সবুজে ছাপা একটা হাওয়াই শার্ট৷ পায়ে ময়লা খাকি প্যান্ট৷ গলায় কালো কারের মালা—তাতে ঝুলছে একটা মাদুলি৷ মাদুলিটা দেখতে ছোটখাটো ঢোলের মতো৷
মোহনের তামাটে রং, ছোট-ছোট চোখ, মাথায় লম্বা চুল৷ এক কানে একটা রুপোর মাকড়ি৷ আর গায়ে উৎকট ঘামের গন্ধ৷
‘মোহন, আমি এই ইস্টিশানের মাস্টারজী৷ তোমাদের বস্তিতে মহাবীরজীর ঘরে ভাড়া থাকি৷ আমার নাম পমেশ চৌধুরী…৷’
একটা আলতো নমস্কারে ও আমার নমস্কার ফিরিয়ে দিল৷ বলল, ‘হাঁ, মালুম হ্যায়—৷’
আমি মোহনের বাঁ-গালের কাটা দাগটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ মোহন আড়চোখে সেটা লক্ষ করছিল৷
আমি অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিলাম৷ ইতস্তত করে বললাম, ‘তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল৷ মানে…৷’
‘কী কথা?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল মোহন যাদব৷
আমি সাততাড়াতাড়ি একটা লাগসই জবাব খুঁজতে লাগলাম৷ ‘দাওয়াই টাউন’-এর ব্যাপারটার তত্ত্বতালাশ করতে চাইলে আগে মোহন যাদবের মুখ খোলানো দরকার৷
‘তোমার গানের গলা বিউটিফুল—৷’
এ-কথায় কাজ হল৷ মোহনের মুখে লাজুক ভাব ফুটে উঠল৷
আমি বললাম, ‘কলকাতার একটা ফাংশানে গান গাওয়ার ডাক পেলে তুমি যাবে?’
মোহনের মুখে আগ্রহ মেশানো একটা মোলায়েম ভাব ছড়িয়ে পড়ল৷
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—জরুর যাব, মাস্টারজী৷’
না, মোহনকে আমি ঠকাব না৷ সত্যি-সত্যিই কলকাতায় আমাদের পাড়ার ক্লাবের অ্যানুয়াল ফাংশানে ওকে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব৷ ওর গানের গলা সত্যিই চমকে যাওয়ার মতো৷
‘হ্যাঁ—সেটা নিয়েই তোমার সঙ্গে একটু কথা বলব৷ এখন তো হবে না—তুমি তো ট্রেন ধরবে…৷’
‘হাঁ, মাস্টারজী৷ আমার পিতাজীর জন্যে টাউন থেকে দাওয়াই নিয়ে আসতে যাচ্ছি৷ আমার পিতাজী গ্যাসট্রিকের খুব শকত পিসেন্ট৷ ট্রিটমেন্টের অনেক খরচা৷’ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল মোহন৷ তারপর নীচু গলায় বলল, ‘আমি তো বিকেলের মধ্যে ওয়াপস চলে আসব৷ তারপর আপনার ঘরে গিয়ে বাতচিত করতে পারি….৷’