‘আমার আইডিয়া, মোহন যাদবও সেরকম কিছু একটা করতে গিয়েছিল৷ ওর সেরকম আদত আছে৷ তো সেই চোরি-ওরি করতে গিয়ে গালে-গলায় চোট পেয়ে এসেছে—৷’
‘ওরকম চোট কী করে হল? কে ওকে মারল?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না—’ মহাবীরজীর তামাটে কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়লঃ ‘মোহনকে অনেকবার জিগ্যেস করেছি—কিন্তু ও ঝাড়াঝাপটা কোনও জবাব দেয়নি৷ ওই যে, সেদিন বললামঃ ‘‘মেরা নসিব৷’’’
‘আপনি কি ভূত, জিনে বিশ্বাস করেন?’
‘না—করি না৷ আমি চাই এলাকার তরক্কি৷ এলাকার উন্নতি হোক৷ যারা ওই হসপিটাল বিল্ডিং থেকে চুরিচামারি করে তারাই বেশি করে ভূত-জিনের কাহানি রটায়৷ যাতে ওদের কাম-কাজ শান্তিতে করতে পারে৷’
মহাবীরজী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন৷ তারপর মাথার পেছনে হাত বোলাতে- বোলাতে বললেন, ‘তবে, পমেশজী…আমার মনে হয় একটা কোনও বেহিসেবি ব্যাপার ওই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে৷’
‘কেন, এ-কথা মনে হয় কেন?’
আমি বুঝতে পারছিলাম, মহাবীরজী একটু দোটানায় ভুগছেন৷ কিন্তু কেন?
‘আট সাল আগে ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ দুটো মার্ডার হয়ে গিয়েছিল৷ ‘‘মার্ডার’’ বলছি বটে কিন্তু কোনও মার্ডারার ধরা পড়েনি৷ পুলিশ ওই জোড়া মার্ডারের কেস সলভ করতে পারেনি৷
‘যারা মার্ডার হয়েছিল তারা আমাদের বাজুওয়ালা বস্তিতে থাকত৷ ছোকরু আর মুন্না৷ দুজনেরই উমর এই ধরুন আটাশ কি তিরিশ হবে৷ ওরা চোরি করে পেট ভরাত৷ হ্যাঁ, ওদের পেশাই ছিল চুরি করা৷ মহল্লার সবাই এটা জানত, কিন্তু কিছু বলত না৷ কারণ, ওরা নিজেদের বা আশপাশের এরিয়ায় কোনও চুরিচামারি করত না৷ কাম-কাজ সারতে দূর-দূর চলে যেত৷ আমাদের সবার আইডিয়া, মুন্না আর ছোকরু ওই হসপিটালে চোরি করতে ঘুসেছিল৷ সেখানে হয়তো আরও একটা গ্যাং চোরি করতে ঘুসেছিল৷ তারপর এনকাউন্টার৷ ব্যস—মুন্না আর ছোকরু মার্ডার হয়ে গেল৷
‘হসপিটালের বাইরের জমিনে ওদের দুজনের ধুলোমাখা বডি পড়ে ছিল৷ কোনও ছুরি-টুরি বা ওই টাইপের কুছু দিয়ে মার্ডারার ওদের গলার নলি কেটে দিয়েছে৷
‘পুলিশ যেটুকু ছানবিন আর ইনভেস্টিগেশান করেছিল তাতে এইটুকু আইডিয়া করতে পেরেছিল যে, ছোকরু আর মুন্নার গলায় রামপুরিয়া চালানো হয়েছে অস্পাতালের ভেতরে৷ ওরা গলায় হাত চেপে ছুটে বেরিয়ে এসেছে বাইরে৷ বেশিদূর যেতে পারেনি —পড়ে গেছে মাঠের ওপরে৷
‘এরকম আইডিয়া করার কারণ, হসপিটালের ভেতরে লিফটের কাছে একটা জায়গায় অনেক রক্ত পড়ে ছিল, আর মাঠে যেখানে ওই চোর দুটোর বডি পাওয়া গিয়েছিল সেখানে সেরকম ব্লাড ছিল না৷ তা ছাড়া, ছোকরু আর মুন্নার ডানহাতে অনেক রক্ত লেগে ছিল৷ এর কারণ, পুলিশ বলেছে, ওরা বোধহয় গলায় হাত চেপে রক্ত আটকাতে কোশিশ করেছিল৷ শেষ পর্যন্ত আর পারেনি৷
‘ছোকরু-মুন্নার মার্ডারার আর ধরা পড়েনি, পমেশজী৷ তাই ওই খুনের জিম্মেদারি ওই ভূতুড়ে অস্পাতালের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আসলে ঠিক কী হয়েছিল কেউ জানে না৷’
মহাবীর যাদবের মুখে এসব কথা শুনতে-শুনতে আমি যেন একটা শেষ-নেই গর্তে তলিয়ে যাচ্ছিলাম৷ একটা অচেনা ভয় চাদরের মতো আমার গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল৷ আমি মোহন, ছোকরু আর মুন্নার কথা ভাবছিলাম৷ ভাঙাচোরা ভূতুড়ে হসপিটালটার ভেতরে কি কোনও ভয়ংকর হিংস্র খুনি লুকিয়ে আছে? কিন্তু এত বছর ধরে লুকিয়ে থাকাটা কঠিন শুধু নয়—অসম্ভবও৷
হসপিটালটার দিকে তাকালাম৷ মনে হল, পোড়া-পোড়া ফাটল ধরা ছ’তলা বাড়িটাকে ঘিরে যেন মেঘের হালকা আস্তর ভেসে বেড়াচ্ছে৷ পাখির মিষ্টি ডাক শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু মেঘলা দিনের সেই মিষ্টি ডাককে আমার কু-ডাক বলে মনে হল৷ সেই ডাক যেন বারবার বলছে, ‘বাড়িটায় কেউ যেয়ো না৷ বাড়িটায় কেউ যেয়ো না…৷’
টাউনের এলাকাটা যেখানে শুরু সেখানে একটা সাইনবোর্ডের মতো লাগানো আছে দেখলাম৷
মহাবীরজী বললেন, ‘আপনাকে যে বলেছিলাম ওয়ার্নিং লাগানো আছে—ওটাই সেই ওয়ার্নিং৷ সরপঞ্চ লাগানোর ব্যবস্থা করেছে৷ ওতে পাবলিককে হুঁশিয়ারি দেওয়া আছে৷’
আমি গাছের গুঁড়ির সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে হসপিটাল-বাড়িটার দিকে চেয়ে রইলাম৷ আমি আগে কখনও কোনও হন্টেড হাউস —মানে, ভূতুড়ে বাড়ি—দেখিনি৷ তবে এটা মনে হল, যে-ছ’তলা বাড়িটা এত পুরোনো, বছরের পর বছর এত অবহেলায় পড়ে আছে, সেটার ‘ভূতুড়ে’ হওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই আছে৷ আর সেটাই আমার দেখা প্রথম ভূতুড়ে বাড়ি৷ যদিও তখনও সেটার ভূতুড়ে চরিত্র টের পাইনি৷ টের পাওয়ার পর বহুবার মনে হয়েছে, টের না পেলেই ছিল ভালো৷
পায়ে-পায়ে ‘দাওয়াই টাউন’-এর সীমানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ তোবড়ানো রং-চটা সাইনবোর্ডটা দুটো বাঁশের খুঁটিতে পেরেক ঠুকে আঁটা৷ জায়গায়-জায়গায় লেখার রং উঠে গেলেও সেটা পড়তে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না৷ ইংরেজি এবং হিন্দিতে লাল রঙে লেখা সাবধানবাণী:
আমি বাড়িটাকে অনুভব করতে চাইছিলাম৷ অলৌকিক কিছু কি সত্যি-সত্যিই আছে ওই বাড়িটায়? যদি থাকে, তা হলে সেই ব্যাপারটা শুরু হল কেমন করে? কেউ কি মারা গেছে ওই হসপিটালে?
কিন্তু হসপিটালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে কোনও-কোনও রোগী মারা যেতেই পারে৷ ব্যাপারটা ব্যাড লাক হলেও বাস্তব৷ তা হলে কি কেউ অপঘাতে মারা গেছে ওখানে?